বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪

বাংলাভাষা সংস্কার Bangla Bhasha Sanskar প্রথম অংশ

 

বাংলা ভাষা সংস্কার ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে নন-ইউনিকোড ফন্টে কম্পোজ করা হয়েছিল৤ এবার তা সংশোধন ও সম্পাদনা করে 
“অহনলিপি-বাংলা১৪” ইউনিকোড ফন্টে পুনর্লিখিত হল 
 (Recomposed in 'AhanLipi-Bangla14'  Unicode font)



প্রবন্ধটি সঠিকভাবে পড়তে হলে বাংলা ফন্ট অহনলিপি-বাংল১৪  ফন্টেই পড়া দরকার৤
‘অহনলিপি-বাংলা১৪ ফন্ট হল-- (১)সেকেন্ড জেনারেশন ফন্ট, (২)স্মার্ট ফন্ট, (৩)বর্ণসমবায় ফন্ট, এবং (৪)আলটিমেন্ট ফন্ট, (৫)বাংলা ফন্ট টেকনোলজির ফলিত প্রয়োগ৤


 

================

 

বাংলাভাষা সংস্কার  Bangla Bhasha Sanskar  

প্রথম অংশ[মোট ৪টি অংশ]

লেখাটি অহনলিপি-বাংলা১৪ AhanLipi-Bangla14 ফন্টেই পড়তে হবে, 

নচেৎ তা অপাঠ্য এবং দুর্বোধ্য হবে৤
 

বিনামূল্যে ফন্ট প্যাকেজ ফ্রি ডাউনলোড লিংক:--


https://sites.google.com/site/ahanlipi/font-download/AhanLipi-Bangla14.zip

কিংবা 

https://sites.google.com/site/ahanlipi/



বাংলা ইন্টারন্যাশনাল ব্লগে প্রকাশিত
পূর্বে প্রকাশিত নিবন্ধটি সর্বাধুনিক “অহনলিপি-বাংলা১৪” ইউনিকোড ফন্টে পুনর্লিখিত হল(মার্চ ২০১৪)
(Recomposed in "AhanLipi-Bangla14"  Unicode font)


বাংলাভাষা সংস্কার

মনোজকুমার দ. গিরিশ
(মনোজকুমার দীনেশচন্দ্র গিরিশ)

মোট ৮৪ পৃষ্ঠা 
(৪-এর প্রথম অংশ-- পৃঃ ১--৩২)

         আমরা প্রত্যেকেই যেন এক-একটা অভিধান-- সেদিন কথা প্রসঙ্গে আমি বললাম একটি সাময়িকপত্রের বর্ষীয়ান সম্পাদক মহাশয়কে৤ টেলিফোনে নানা আলোচনা হচ্ছিল বাংলা বানান নিয়ে৤ শুনে তিনি বললেন, এনিয়ে একটা লেখা লিখুন না৤ আমারও মনে ধরল ব্যাপারটা৤ 

        নানা কথা হচ্ছিল বাংলা বানান প্রসঙ্গে৤ তিনি বললেন, ‘শ্রেণী’ শব্দটাকে আমি হ্রস্ব-ই কার দিয়ে শ্রেণি করতে পারছি না এখনও৤ চেষ্টা করছি তেমন লেখার৤ আজকাল তো ‘তীর’ লেখা হচ্ছে হ্রস্ব-ই কার দিয়ে ‘তির’৤ সব কাগজগুলি যদি এক বানান লেখেন তাহলে সব ক্ষেত্রে এক বানান চালু হতে সুবিধা হয়৤ আমি বললাম সেটা তো হবে না, কারণ প্রত্যেক কাগজের নিজস্ব একটা মত আছে৤ সে মত আবার পরস্পর বিরোধী৤ তাহলে আর এক-বানান হবে কী করে? এই যেমন ধরুন ‘নদী’ লিখলে যেমন বেশ এক গভীর জল-প্রবাহিনী বোঝায়, ‘নদি’ লিখলে তেমন যেন বোঝায় না৤ কেমন যেন অগভীর নির্ঝরিণী মনে হয়৤ উনি শুনে হাসলেন৤ কারণ কথাটা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না৤ এক-একটা জিনিসের এক-একটা পরিচিতি থাকে, সে পরিচয় থেকে সরে গেলে তাকে চেনা হঠাৎ-করে বেশ কষ্টই হয়৤ ছেলেবেলা থেকে আমরা যে জিনিসকে যেভাবে চিনে এসেছি তাকে তো সেই ভাবেই দেখতে, শুনতে, চিনতে অভ্যস্ত, তার হেরফের হলেই জিনিসটাকে কেমন অচেনা অপরিচিত লাগে৤ তাই নদী-কে ‘নদী’ লিখলেই আমরা স্বস্তি পাই৤ ‘নদি’ লিখলে তার গভীরতা নিয়ে সন্দেহ জাগে৤ বাংলা বানান নিয়ে এত যে মতান্তর তার মূল কারণটি রবীন্দ্রনাথ চমৎকার করেই বলেছেন__ "একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না৤ কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি৤...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে৤ যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয়৤ মতের অনৈক্যে রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার৤"(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা শব্দতত্ত্ব (তৃতীয় স্বতন্ত্র সংস্করণ, বৈশাখ-১৩৯১ (১৯৮৪-এপ্রিল),) কলকাতা৤ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ৤ পৃঃ১-২)৤ 

          এটা হল পরিচয়ের ব্যাপার৤ কিন্তু যদি একটা অপরিচিত জিনিসের নাম লিখি তবে তার বানান হ্রস্ব-ই কার দিয়ে লিখি বা ঈ-কার দিয়ে লিখি, সেটা তেমন কোনও বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না৤ ধরি, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি নদীর নাম হল-- বাশি৤ বাংলায় নদীটির নামের বানান ‘বাশি’ হওয়াতে কোনও অসুবিধা নেই৤ কিন্তু যদি নদীর নামটি ইংরেজিতে লেখা দেখি তবে একটা যেন ছোটো অস্বস্তি আমাদের মনে খচখচ করতে থাকে৤ ইংরেজিতে শব্দটি হল--BASHEE, অমনি আমাদের মনে হবে, আহা এর বাংলা বানান তো হবে ‘বাশী’৤ আর এই দুঃখের বাঁশি আমাদের মনে অনুরণিত হতে থাকবে৤ কিন্তু এর ইংরেজি বানান তো--BASHI / BASI / BASY / BASHY / BASHIE / BASIE হতে পারত, তখন কী করতাম? 



        এই প্রশ্নের একটা মোটামুটি ভালো সমাধান পেলে বানান নিয়ে আমাদের এত এত যে সমস্যা তার অনেকখানিরই সুরাহা হবে৤ বাশি শব্দটি যখন আমরা প্রথমে লিখছি, তখন ইংরেজি বানানটি না দেখেই লিখছি৤ তখন ‘বাশি’ লেখায় কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই৤ যখনই এর ইংরেজি বানানটি দেখছি তখনই মনে নাড়া লাগছে, দ্বিধা জাগছে৤ শব্দটির যা উচ্চারণ হওয়া উচিত, বা আমাদের মুখে যে উচ্চারণ হয়, প্রথমে আমরা তেমনি করেই তা নির্দ্বিধায় লিখেছি৤ পরে ইংরেজি বানান দেখে মনে হয়েছে বানানটা ইংরেজির কায়দায় লিখলে ভালো হত, অর্থাৎ তালব্য শ-এ দীর্ঘ ঈ-কার দিলে ভালো হত৤ এর ফলে আমরা আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা অ-স্বীকার করে অন্য কোনও কিছুর অনুসরণ করছি৤ যার সত্যিকারের কোনও দরকার নেই, কেবল অভ্যাসবশে পূর্ব-অনুসৃতি ঘটাচ্ছি৤ 

        ‘তীর’ শব্দটি কেন আজকাল ‘তির’ লেখা হচ্ছে? তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল এই যে, ‘তীর’ শব্দটি সংস্কৃত নয়, ফারসি শব্দ৤ সুতরাং এর বানান ‘তির’ লেখায় কোনও বাধা নেই৤ যে-শব্দগুলো সংস্কৃত নয়, সেগুলো সংস্কৃতের নিয়ম মেনে লিখতে হবে না৤ কেবল সংস্কৃত শব্দগুলো সঠিক সংস্কৃত বানান মেনে লিখতে হবে৤ এ নিয়মটি ভালো, কিন্তু এতে যে সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে৤ কারণ কোন্‌ কোন্‌ শব্দ সংস্কৃত তা না জানলে তার বানানে সংস্কৃত শব্দের বানানের যে নিয়ম তা প্রযুক্ত হয়ে যেতে পারে৤ তখন বানানে বিভ্রাট দেখা দেবে৤ যেমন ‘গভর্নমেন্ট’ শব্দটি মূর্ধন্য ণ-এ রেফ দিয়ে ‘গভর্ণমেন্ট’ লেখা ঠিক নয়৤ শব্দটি বিদেশি ইংরেজি তাই এখানে সংস্কৃত নিয়মের সংস্কৃত ণ-ত্ব ষ-ত্ব বিধির প্রয়োগ হবে না৤ কারণ ভাষাটি যে সংস্কৃতের এখতিয়ারের/এক্তিয়ারের বাইরে৤ 

        বাংলায় খাঁটি সংস্কৃত শব্দ আছে প্রায় ৪৪ শতাংশ, আর সংস্কৃত থেকে তৈরি বা দেশি শব্দ হল ৫১.৪৫  শতাংশ৤ এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলো দেখে সংস্কৃত বলে মনে হবে, কিন্তু তা সংস্কৃত নয়৤ আবার অনেক সংস্কৃত শব্দ আছে যেগুলির বানান দুটি বা দুরকম৤ সেসব ক্ষেত্রে ঠিক কোন্‌ বানানটি নেওয়া হবে তা নিয়ে মতভেদ হতে পারে৤(এখানে বলে রাখি যে, সংস্কৃতে একাধিক ব্যাকরণ আছে, সুতরাং দু-রকম বানান সেখানেও হতে পারে!)৤ 

        আমরা জানি সংস্কৃতে অনেক বিখ্যাত বৈয়াকরণ আছেন৤ পণ্ডিত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী তাঁর ‘নূতন বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে বলেছেন--“ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, গর্গ, গালব, ইন্দ্র, চন্দ্র, আপিশলি, স্ফোটায়ন, শাকল্য, শাকটায়ন, পাণিনি, সর্ববর্ম্মা, বোপদেব, সুভূতি প্রভৃতি বহুসংখ্যক সূত্রকার -- ও কাত্যায়ন, পতঞ্জলি, ব্যাড়ি, জয়াদিত্য, বামন, জিনেন্দ্র, দৌর্গসিংহ, ভর্ত্তৃহরি, ভট্টোজিদীক্ষিত প্রমুখ অসংখ্য বৃত্তিকার ও ভাষ্যকার জন্মগ্রহণ করিয়া ভারতবর্ষের পুরাতন ... সংস্কৃতভাষার অসীম উন্নতি সাধন করিয়াছেন৤”(উদ্ধৃতি সরস্বতী মিশ্র-র “বিতর্ক বাংলা ব্যাকরণ” থেকে)৤ এখন যেমন বাংলা বানান সংস্কার করতে গিয়ে সংস্কৃত-পন্থী, আধুনিক-পন্থী বা অন্য পন্থী বানান-সংস্কারকগণ আছেন, তাই একজনের সঙ্গে অন্য জনের পুরো মিল নেই৤ প্রাচীনকালের এঁরাও হয়তো  তেমনি ছিলেন৤ সংস্কৃত বানানেও তাই একই শব্দের বিভিন্ন বানান আছে৤ এখন যেমন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, আনন্দবাজার পত্রিকা -- প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা বাংলা বানানসংস্কার করে বই বের করেছেন, সেযুগেও তার বিশেষ অন্যথা ছিল বলে মনে হয় না৤ তাই যাঁরা বলেন সংস্কৃত শব্দের বানান অনুযায়ী বাংলা বানান অপরিবর্তিত তথা সংস্কৃতই রাখতে হবে, তাঁরা তাহলে আগে বলুন তাঁরা কোন্‌ পন্থী? ভরদ্বাজ, কাশ্যপ, গর্গ, গালব, ইন্দ্র, চন্দ্র, আপিশলি, স্ফোটায়ন, শাকল্য, শাকটায়ন, পাণিনি, সর্ববর্ম্মা, বোপদেব, সুভূতি পন্থী বা অন্য কোন্‌ পন্থী? এবং সঙ্গে ব্যাখ্যা করলে ভালো হয় সেই পন্থা কেন অনুসরণ করা হবে, অন্যেরা কী দোষ করলেন? 





          সংস্কৃত একটি প্রাচীন মৃত ভাষা-- তার বানান কেন জীবিত এবং সচল ভাষা, এযুগের ভাষা -- বাংলায়-- অমোঘ এবং অপরিবর্তিত থাকবে? সংস্কৃত থেকে সম্পদ সংগ্রহ করা মানে তো সংস্কৃত-পাথর চাপা পড়া নয়! তা কি পোখরাজ মণি, নাকি তা রেল লাইনের ধারে দেবার গ্রানাইট পাথর? তা কি অঙ্গভূষণ, নাকি তা প্রাকার নির্মাণের উপকরণ? 

         সংস্কৃত শব্দের বানান বাংলায়-- বাংলা রীতি অনুযায়ী বাংলা উচ্চারণে, বাংলা হরফে, বাংলা করে না-লিখতে দেওয়ার জন্য, বাংলা বানানে ভুলের যত ছড়াছড়ি৤ 

        ইংরেজি শব্দের বানান তো বাংলায় ‘ইংরেজি’ করে হয় না, তাহলে সংস্কৃত শব্দের বানান বাংলায় কেন ‘সংস্কৃত’ করেই করতে হবে? তার একটা সম্ভাব্য কারণ হল এই যে, সংস্কৃত হল দেবভাষা৤ তাই সংস্কৃত থেকে আগত শব্দের বানান একান্তভাবেই সংস্কৃত হতে হবে৤ এর অন্যথা করা যাবে না৤ পণ্ডিত থেকে সাধারণ মানুষ কেউই সেরকম বানান মেনে নেবেন না৤ অর্থাৎ বানান হল এক অ-লিখিত সামাজিক চুক্তি৤  সে চুক্তি তো সবাইকেই মেনে চলতে হবে৤ বেশ, তাই হবে, কিন্তু নতুনভাবে নতুন পথে অন্য কিছুও তো ভাবা যেতে পারে৤ সংস্কৃত শব্দের বানান বাংলায় সংস্কৃত করে লিখতে হবে-- কিন্তু কেনই-বা সংস্কৃত করে লিখতে হবে? তার জবাব কী? সংস্কৃত আমাদের অভিভাবক ভাষা? সেজন্য কি বাংলা শব্দের বানান সংস্কৃত করে লিখতে হবে? আমাদের মাতৃ ঋণ, বা পিতৃ ঋণ শোধ করার জন্যই কি এই নিদান? এখানে প্রশ্ন এই-- তাহলে বানান ব্যাপারটা কী? বানান কাকে বলে? বানান কীসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, বা লেখা হয়? 

        সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে এরকম মত প্রচলিত আছে যে, সংস্কৃত ভাষা হল বাংলা ভাষার জননী৤ তাই মা-ভাষা তথা জননী ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনও কথা কেউ সমর্থন করবেন না৤ মা-ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার এরকম কোনও বাতুল কথাবার্তা লোকে শুনতেই রাজি নন৤ কিন্তু কোনও কোনও ভাষা বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত বলেন যে, সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার জননী নয়৤ এই মতবাদ যাঁরা প্রচার করেন তাঁদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী(১৮৫১-১৯৩১) মহাশয়ও আছেন৤ আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় হলেন সংস্কৃত ভাষার মহাপণ্ডিত৤ তাঁর অভিমতকে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা কারও নেই৤ তিনিই নেপাল থেকে এনে বাংলা আদি পুথি চর্যাগীতিকোষ  তথা “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা” বা চর্যাচর্যবিনিশ্চয় তথা চর্যাপদ প্রকাশ করেন৤ তাঁর অভিমত হল, বাংলার সঙ্গে সংস্কৃতের সম্পর্ক আছে ঠিকই, কিন্তু সে সম্পর্ক অতীব দূর গোষ্ঠী-সম্পর্ক মাত্র৤ 


                     উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
       মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
(উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায়ূরপুচ্ছ, গলা গুঞ্জামালিকা।)

        গোষ্ঠী বিচার করলে দেখা যাবে উত্তর ভারতের অনেক ভাষাই একই গোষ্ঠীভুক্ত৤ কিন্তু সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই৤ ভাষাতত্ত্বে একটা কথা চালু আছে যে, প্রতি দশ মাইলে(প্রায় ১৬ কিলোমিটার) ভাষার সামান্য সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়৤ আর সংস্কৃত ভাষা প্রচলিত ছিল বর্তমান পাকিস্তানের সুদূর ‘আটক’ অঞ্চলের শলাতুরে৤ 


(Pushkalavati, Gandhara, in modern day Charsadda District of Khyber Pakhtunkhwa প্রদেশ, in Pakistan, 6th century BC. হিউয়েন সাং-এর বিবরণ অনুসারে পাণিনির জন্ম সিন্ধু নদীর পশ্চিম তীরে তক্ষশীলার কাছে শলাতুর গ্রামে, যা বর্তমান কালের উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানের লাহোর৤ Taxila is a town and an important archaeological site in the Rawalpindi District of the Punjab province in Pakistan. পাণিনি পারিবারিক নাম, অর্থ পাণির বংশধর, ছিলেন একজন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ।  তিনি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গান্ধার রাজ্যের পুষ্কলাবতী নগরীতে বিদ্যমান ছিলেন। তিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী অর্থাৎ আট অধ্যায়” নামক সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। ... অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম ব্যাকরণগুলির অন্যতম। যদিও পাণিনি উনাদিসূত্র, ধাতুপাঠ, গণপাঠ প্রভৃতি তাঁর পূর্বসূরিদের কয়েকটি ব্যাকরণগ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন।--উইকিপিডিয়া)


         অর্থাৎ যেখানে পাণিনির জন্ম৤ ভারতের সঙ্গে যার এখন অবশ্য কোন সম্পর্ক নেই৤ এখান থেকে তার দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার! সুতরাং সে-ভাষার সঙ্গে জল জঙ্গল জলৌকার (জোঁকের) এই দেশের ভাষা-- বাংলার সম্পর্ক কী থাকতে পারে, যখন সেই অতীত যুগে হাঁটা ছাড়া  যোগাযোগের কোন ভালো ব্যবস্থাই ছিল না? একজন ভাষা বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত বলেন বাংলায় বহুল সংস্কৃত শব্দের প্রচলন দেখে কেউ যদি মনে করেন যে সংস্কৃত থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম,





         তবে তা ভুল, কারণ ইংরেজি ফারসি ইত্যাদি অনেক ভাষার শব্দই বাংলায় বহুল প্রচলিত৤ অন্য একজন ভাষা বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত বলেন যে, বাংলায় সংস্কৃত শব্দ বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হবার কারণ হল, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের যুগে সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রবল প্রভাবে বাংলায় এত সংস্কৃত শব্দের ছড়াছড়ি হয়েছে৤ মনে রাখতে হবে যে, বাংলা গদ্যের শুরু ও বিকাশ এসময়েই হয়েছে৤ এতে অবশ্যই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সংস্কৃত থেকে আগত(এবং বাংলায় গৃহীত) বাংলা শব্দের বানানও সংস্কৃত-বানান মেনে করতে হবে৤ তাহলে তা আর বাংলা ভাষায় সুপ্রযুক্ত হল কোথায়? তা তো প্রকৃত পক্ষে সংস্কৃত হয়েই রইল৤ ইংরেজি, সংস্কৃত, ফারসি বা অন্য যে-কোনও ভাষার শব্দ যা-ই বাংলায় আসছে বা আমদানি করা হচ্ছে তার বানান বাংলাই হতে হবে৤ ইংরেজি TABLE বাংলায় কি-- টেইব্‌ল্‌/ঠেএব্‌ল্‌ লেখা হয় নাকি? লেখা তো হয় টেবিল(Tebil)! তেমনি GLASS/গ্ল্যাস্‌ লেখা হয় গেলাস/শ(Gelas/sh)৤ তা হলে সংস্কৃত ‘আত্মীয়’ শব্দটি বাংলায় কেন ‘আত্তিয়’ লেখা হবে না? ব্যাপারটা বিতর্কিত৤ এ নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করা যাক৤ 

        বাংলা লেখা হয় বাংলা হরফে৤ এ ছাড়া-- অহমিয়া, মণিপুরি, ককবরক(ত্রিপুরি), কিছু অংশ সাঁওতালি, এবং বাংলাভাষী অঞ্চলে বাংলা হরফে মুণ্ডারি/মুন্ডারি লেখা হয়৤ তাই, খুব স্পষ্ট করে মনে রাখা দরকার যে, ‘বাংলালিপি’ বাংলার একান্ত নিজস্ব কোনও ব্যাপার নয়৤ এ লিপি এ-সকল ভাষার সবারই নিজস্ব লিপি৤  

        বাংলাদেশের লেখক খন্দকার মুজাম্মিল হক তাঁর ‘পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পাঠ-সম্পাদনা’(অবসর, ঢাকা, বাংলাদেশ, জুন ২০০০) গ্রন্থে লিখেছেন,পুথির হস্তাক্ষর/লিপি: এ-ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়৤ পুথিটি কোন লিপিতে অনুলিপিকৃত ...  সাধারণত বাঙলা ছাড়াও আরবি-ফারসি হরফে বা নগরি হরফে বাঙলা পুথি লিখিত হয়”(পৃঃ-২৭)৤  

        রোমান লিপি যেমন এখন ইংরেজি লেখার লিপি, আরও শতেক ভাষা লেখারও লিপি, সে লিপি এখন বিশ্বজনীন৤ আর একটি কথা, তা হল বঙ্গদেশে সংস্কৃত লেখার লিপি হল বাংলা৤ অন্যান্য প্রদেশেও সংস্কৃত লেখা হয় সেই সেই প্রদেশের নিজস্ব লিপি ব্যবহার করে৤ কারণ, সংস্কৃতের নিজস্ব কোনও লিপি নেই৤ কোনও কালে ছিলও না৤ একথা বলায় একটি প্রশ্ন সংগতভাবে এসে যায়, তা হল, যে-লিপিতে এখন  সংস্কৃত লেখা হয়, সেটা তাহলে কী? সেটা কি সংস্কৃত লিপি নয়? 

          খুব আশ্চর্য ও দুঃখের বিষয় হলেও বলতে হয় যে-- না, সেটা সংস্কৃতের লিপি নয়৤ সংস্কৃতের কোনও লিপি নেই, কোনও কালে ছিলও না৤ প্রাচীন মহাভারতের পুথি মোট আট প্রকারের লিপিতে পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে৤ সেসব লেখা হয়েছে নানা অঞ্চলের নিজ নিজ লিপিতে৤ বেণীমাধব শীল সম্পাদিত ‘কাশীদাসী মহাভারত’ গ্রন্থের ভূমিকায় (২৫বৈশাখ, ১৩৯৪) বলা হয়েছে-- “প্রাচীন মহাভারতের পুঁথি মোট আট প্রকারের লিপিতে পাওয়া গিয়াছে--(১)কাশ্মীরাঞ্চলে শারদা-অক্ষর৤ (২)মধ্য ও উত্তর ভারতে নাগরী অক্ষর৤(৩)মিথিলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মৈথিল অক্ষর৤ (৪)পূর্বভারতে বাঙলা অক্ষর৤(৫)নেপালাঞ্চলে নেপালী অক্ষর৤ (৬)দাক্ষিণাত্যে তামিল অক্ষর৤ (৭)তেলেগু অক্ষর এবং (৮)মালয়ালম্ অক্ষর৤” এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কোথাও কিন্তু “দেবনাগরি” নামক কাল্পনিক হরফে প্রাচীন মহাভারত লেখা হয়নি, এবং বোঝা যাচ্ছে এই ক’টিই ছিল প্রধান অঞ্চল৤ আমরা কি ইংরেজি লিখি বাংলা হরফে, কিংবা নাগরি হরফে, তামিল হরফে? যেহেতু ইংরেজি লেখার লিপি আছে তাই তা সর্বত্র ইংরেজি তথা রোমান হরফে লেখা হয়৤ 

        এ ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞের অভিমত উল্লেখ করা যাক৤ ‘আজকাল’ পত্রিকাগোষ্ঠী প্রকাশ করতেন “সকাল” নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা, তার শারদীয় ১৪০০ সংখ্যায় শিশির চক্রবর্তী লেখেন, “সংস্কৃত ভাষার কিন্তু নিজস্ব লিপি নেই৤ আমরা যাকে সংস্কৃত লিপি বলি তা আসলে নাগরী লিপি৤ সংস্কৃত পুঁথি লেখা হত বিভিন্ন প্রাদেশিক লিপিতে৤ দেবনাগরী অক্ষরে সংস্কৃত লেখা বা ছাপা শুরু হয় অনেক পরে৤ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য শ্রীরামপুর খ্রিস্টান মিশন থেকে যে-সমস্ত সংস্কৃত গ্রন্থ মুদ্রিত হয়




(যথা-- বাল্মীকির মূল রামায়ণ) তাতে সর্ব প্রথম নাগরী লিপির ছাঁচে ছাপার জন্য নাগরী লিপির অক্ষর তৈরি হয়! তার আগে পুঁথিপত্রে যাবতীয় সংস্কৃত রচনা বাংলাতেই হত৤ কেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য ব্যবহৃত (সংস্কৃত) গ্রন্থে নাগরী লিপি ব্যবহৃত হল, তার কারণ, এই কলেজে উত্তরপ্রদেশ আর বিহার থেকে যে-সমস্ত সংস্কৃত শিক্ষক আসতেন তাঁরা নাগরী লিপিতে অভ্যস্ত ছিলেন বলে শ্রীরামপুর মিশন সংস্কৃত গ্রন্থে ছাঁচে-তৈরি নাগরী-অক্ষর ব্যবহার করত৤ তখন থেকে কলকাতায় ছাপা প্রায় সমস্ত (সংস্কৃত) গ্রন্থে নাগরী-হরফ ব্যবহৃত হত৤ তাই অনেক বাঙালি পণ্ডিতের ধারণা হয়েছিল নাগরীলিপিই সংস্কৃত অক্ষর এবং যেহেতু সংস্কৃতভাষা ‘দেবভাষা’ সেই জন্য নাগরীকে দেবনাগরী বলে গৌরব দেবার চেষ্টা করা হয়েছে৤” এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন-- ‘বাংলা লিপির উদ্ভব নাগরী লিপি থেকে নয়, অন্যভাবে৤’ (পৃঃ ৩৪৪-৩৪৬)৤ 

        বিচল হরফে বাংলা ছাপা শুরু হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে৤ তারপরে এই বঙ্গেই ছাপার জন্য নাগরি হরফ টাইপও তৈরি হয়৤ তারপরে তাতে সংস্কৃত ছাপা হয়৤ তার আগে তো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্কৃত পুথি লেখা হত সেই সেই অঞ্চলের লিপিতে৤ নাগরি বা দেব গৌরব প্রাপ্ত দেবনাগরিতে তা লেখা হয়নি৤ ছাপার সুবিধা এই যে তাতে বহু বই একবারেই ছাপা যায় এবং তা সহজে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যেতে পারে৤ এটাই তো শিক্ষার প্রসারে বিজ্ঞানের অবদান৤ হাতে পুথি নকল করার কঠিন দিনের অবসান তো এভাবেই হয়েছে৤ 

        নাগরি এবং দেবনাগরি নিয়ে অন্য একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যাক৤ ভারতেস্বাধীনতার পরে সরকারি কাজের ভাষা করা হয় হিন্দিকে, আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয় উর্দু৤ হিন্দি এবং উর্দু দুটি নাম, কিন্তু আসলে তা একটিই ভাষা, তার লিপি কেবল আলাদা৤ মুসলিম ঝোঁক যে ভাষাতে বেশি সেটি হল উর্দু, তা আরবি-ফারসি লিপিতে লেখা হয়, আর হিন্দু ঝোঁক যেটাতে বেশি সেটা হল হিন্দি, তা দেবনাগরি লিপিতে লেখা হয়৤ উর্দু লেখা হয় আরবি-ফারসি লিপিতে আর হিন্দি লেখা হয় দেবনাগরি লিপিতে৤ বিশেষ করে ‘হিন্দুর’ ভাষা বলে পার্থক্য বোঝাতে নাগরি কথাটির সঙ্গে  দেব”  কথাটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তা হিন্দুর ব্যবহার্য এটা সহজে বোঝানো যায়৤ নাগরি কথাটি প্রাচীন হলেও  ‘দেবনাগরি’ কথাটি নবীন৤ বিংশ শতকের শুরুতে ‘দেবনাগরি’ কথাটির প্রচলন হয়৤ শিবিরের ভাষা উর্দু দিল্লির সুলতান এবং মুঘলসাম্রাজ্যের কালে প্রচলিত হয়, তাই হিন্দির মধ্যে সংস্কৃত শব্দ ঢোকানো হয় এবং ঢোকানো হচ্ছে, উর্দু থেকে তাকে আলাদা অভিধা দিতে৤ তাই বলা যায় ভারত এবং পাকিস্তানে আসলে একই ভাষাকে তার দুই রূপ-এ দুই দেশের রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি কাজের ভাষা করা হয়েছে! সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বর্তমান লেখককে জানিয়েছেন, হিন্দি উর্দু আসলে একই ভাষা-- দুই লিপি, এবং তিনি ডান বাম দু-হাতে করেই তা লিখতে পারেন৤ ‘বাংলাভাষা প্রসঙ্গে’ বইয়ে সুনতিকুমার বলেছেন,  “সমগ্র ভারত জুড়িয়া নাগরীর প্রচলন একেবারেই ছিল না৤” তিনি আরও বলেছেন, উর্দুকে “মুসলমানী হিন্দী” বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে৤ 




        “বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে দেবনাগরী হরফে সংস্কৃত পুস্তক ছাপতে আরম্ভ করেন৤”(বাংলা মুদ্রণের চার যুগ, বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন, জুন-১৯৮১, সম্পাদনা- চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ-১০১)৤ প্রসঙ্গত বলা ভালো যে, ছাপার জন্য নাগরি হরফ প্রথম তৈরি হয় শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে৤ ছাপার হরফের বয়স বেশি নয়৤ (দ্রঃ- ‘সাহেবদের ঠাকুর’, শিশির দাশ, ঐ, পৃঃ-৬৯, এবং ৭৫)৤ 

        সংস্কৃত লেখা হয় বলে যদি নাগরি লিপিকে দেবনাগরি  বলা হয়, তবে বাংলা লিপিতে সংস্কৃত লেখা হয় বলে বাংলা লিপিকেও দেববাংলা বলা দরকার, কিন্তু এ সব বাহুল্যমাত্র৤ 

        এ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেমন সেই সেই অঞ্চলের লিপিতে চিরকাল সংস্কৃত লেখা হত, সেই মতোই এই বঙ্গভূমিতেও চিরকাল সংস্কৃত লেখা হত, এবং এখনও লেখা হয় বাংলা লিপিতে৤ আরও একটা কথা বলা দরকার তা হল, সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে বড় এবং মান্য অভিধান হল--Sir Monier Monier-Williams-- কৃত A Sanskrit-English   Dictionary. বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে Oxford University Press থেকে৤ পরে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তার ভারতীয় পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়৤ এই গ্রন্থের শুরুতে --THE  DICTIONARY ORDER OF THE  NAGARI  LETTERS, বলে নগরি হরফের তালিকা দেওয়া হয়েছে৤ লক্ষ করার বিষয় যে, এই সংস্কৃত অভিধানে কিন্তু এই হরফকে নাগরি হরফ বলা হয়েছে, ‘দেবনাগরি’ বলা হয়নি৤ 


 
        একটা কথা বলা দরকার-- ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম লিপি হল ব্রাহ্মীলিপি৤ শিলার উপরে এই ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা অনেক প্রাচীন সংস্কৃত লিখন তথা শিলালিপি দেখা যাবে নানা স্থানে, কোলকাতার জাদুঘরেও অশোকের আমলের শিলালিপি রাখা আছে৤ সুতরাং নাগরি লিপিতে যে প্রথম সংস্কৃত লেখা হয়নি একথা তো পরিষ্কার৤ আর যে লিপিতে প্রথম সংস্কৃত লেখা হয়েছে সেটাই তো হবে সংস্কৃত ভাষার লিপি৤ সুতরাং নাগরির শুভনাম “দেবনাগরি” হওয়ায় সে লিপির মর্যাদা বেড়েছে, কিন্তু তা ইতিহাস নয়৤ যদি সংস্কৃতলিপি একান্ত  কাউকে বলতেই হয়, তবে তা হল প্রাচীনতম লিপি-- ব্রাহ্মীলিপি৤ 

        যাহোক, বাংলা  লিপিতে সংস্কৃত লেখা হয়, এবং বাংলা তো লেখা হয়ই, তাই একই শব্দ যখন বাংলায়ও লেখা হল এবং সংস্কৃতেও লেখা হল তখন যদি শব্দটির বানান দুই ক্ষেত্রে দুই রকম হয়, তবে বিভ্রাট হবে৤ অর্থাৎ সংস্কৃতে লেখা হল--আত্মীয়(বাংলা হরফে), এবং বাংলায় লেখা হল আত্তিয়(বাংলা হরফে), তবে খুবই বিপদ হবে! আর সেই বিপদ এড়াবার জন্যই সংস্কৃত এবং বাংলা দুই ক্ষেত্রেই “আত্মীয়”[বাংলা হরফে] লেখা হয়৤ 

        কিন্তু আসল বিপদ তো অন্যত্র৤ আত্মীয় লিখলে তা কি বাংলা লেখা হল? অনেকেই বলবেন, তা না হোক, ‘আত্মীয়’-ই লেখা হবে৤ এতে সংস্কৃতের সঙ্গে বানান নিয়ে বিভ্রাট হবে না, তা ছাড়া সংস্কৃতের সঙ্গে পুরো মিলও থাকবে৤ তাতে অবশ্য সন্দেহ নেই, মূল প্রশ্ন কিন্তু থেকেই গেল অর্থাৎ-- সেটা বাংলা হল কি, বা বাংলা থাকল কি? 

        এইখানে একটু বেশ ডেঁটে বলতে হবে-- বাংলা বানান বাংলাই হবে, অন্য কিছু নয়৤ আত্তিয়-ই লিখতে হবে, অন্য কিছু নয়৤ আমাদের কাজ বাংলা নিয়ে পুরানো মৃত ভাষা সংস্কৃত নিয়ে নয়৤ তাহলে অহমিয়া, মণিপুরি, ককবরক, সাঁওতালি, মুণ্ডারিতে(সবই বাংলা হরফে) যেভাবে সেসব ভাষার শব্দের বানান লেখা হয়, আমরা কি সেসব ঠিক তেমনিভাবেই লিখব? সেসব ভাষা তো পুরো বা আংশিক বাংলা লিপিতেই লেখা হয়৤ আমরা কি সেসব তেমনিভাবে লিখব? 

         সেসব ভাষা বাংলা লিপিতে লেখা হলেও তাঁদের লেখার ধরন ধারণ তো সম্পূর্ণ আলাদা৤ যেমন-- ককবরক “অৗংখা” শব্দটির অর্থ আমার জানা নেই, কিন্তু শব্দটি যদি বাংলায় লিখতে হয়, তবে অৗংখা করে লেখা হবে কি? নাকি বাংলা পদ্ধতিতে ‘বাংলা’ করে লেখা হবে? অথবা লেখা হবে-- হাঅ, বৗখাঅ, দৗ, কা-অ, তঙখক, য়ংমাল, নীতিঅ, রৗচাবমুঙ, উাইজৗই--ইত্যাদি? 
        এখানে  উদাহরণ হিসেবে দেখানো শব্দগুলির অর্থ আমার একেবারেই জানা নেই, কিন্তু এসবের বানান বাংলায় যে এভাবে লেখা হবে না সেটা তো ঠিকই৤ তেমন করে লিখলে আমরা তা পড়তেই তো পারব না৤ 

       সংস্কৃত ধ্বাঙ্ক্ষ শব্দটি, বাংলা অভিধানেও আছে, অর্থ কাক৤ বাংলায় শব্দটি ‘ধাংখ’ লেখা যাবে না, পণ্ডিতেরা তেমন অনুমোদন দেবেন না৤ কারণ শব্দটি যে সংস্কৃত, তাকে মান্য না-করার সাহস কে দেখাবেন? অহমিয়া, মণিপুরি, ককবরক, সাঁওতালি, মুণ্ডারিকে অমান্য করে উড়িয়ে দেওয়া যায়, দেবভাষাকে হেলা করবে কে? তাই, বাংলার পক্ষে যতই অসংগত হোক, সংস্কৃত শব্দের বানান সংস্কৃত করে রাখা-ই বাধ্যতামূলক! “স্কুলের ব্যাকরণ তাঁর(রবীন্দ্রনাথের) একদম পছন্দ ছিল না৤ তখনকার স্কুলের ব্যাকরণে প্রায় ধরেই নেওয়া হত যে, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত থেকে বানানসুদ্ধ ধার-নেওয়া ‘তৎসম’ শব্দ ছাড়া আর বাকি যা আছে, সে সব শব্দ জাতে খুব নিচু৤ কাজেই ব্যাকরণে তাদের খবর নেওয়ার দরকার নেই”(রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাকরণ লিখতে চেয়েছিলেন-- পবিত্র সরকার৤ আজকাল, পৃঃ-ঘ, ০৮/০৫/১৯৯৪)৤ [চর্যাপদের ভাষায় শবরী বালিকা-র কথা বলা হয়েছে তার মাথায়ূরপুচ্ছ, গলা গুঞ্জামালিকা এ ছবি আবার বাংলাভাষার জাতের পাঁতি নিয়ে ঘোঁটের কারণ হবে না তো! সংস্কৃত কখনও শবরী নয়, আর মাথায় গুঞ্জামালিকাও পরিধান করবে না]৤ 


 

        এ যুগে সংস্কৃতের এ বাধ্যতা লোকের কাছে আর তেমন যুক্তি-সহ মনে হচ্ছে না৤ সংস্কৃত-- মানুষের ভাষা হোক বা দেবতার ভাষা, বাংলা বাংলা-ই, তাই তার বানান বাংলা করেই লিখতে হবে, এ ব্যাপারে কোনও আপস নেই৤ যে-কোনও আগত শব্দ বাঙালির মুখে যেভাবে উচ্চারিত হয়, বাংলায় তার বানান লেখা হবে ঠিক তেমনি করেই, অন্য কোনও অভিভাবক ভাষার প্রচ্ছন্ন অঙ্গুলি হেলনে নয়৤ এযুগে, যদি দরকার হয় তবে, অচলিত মৃত ভাষা সংস্কৃতের বানান বরং লেখা হবে আধুনিক ভাষা বাংলা-বানানের রীতিতে৤ বাংলা বানান কখনওই সংস্কৃতের রীতিতে লেখা হবে না৤ অর্থাৎ সংস্কৃত এবং বাংলা উভয় ক্ষেত্রেই বানান লেখা হবে-- আত্তিয় 

        এসব কথা সহ্য করা অনেকের পক্ষে খুবই কঠিন, এবং হৃদয়বিদারকও বটে, কারও কারও মনে এজন্য পাপবোধও হয়তো জেগে উঠবে৤ ছোটো মুখে বড় কথা বলে মনে হবে৤ হবেই!  বাংলাভাষার অধিকার এবং এক্তিয়ার(এখ্‌তিয়ার?) নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! তা উঠলেও এটাই কিন্তু করা হবে৤ অবশ্য সংস্কৃতের এক্তিয়ার নিয়ে কোনও প্রশ্ন করা যাবে না৤ সে যা-ই হোক, আমরা পিছনে ফিরে প্রাচীন যুগে যেতে চাই না, আমরা সামনে এগোতে চাই৤ 

        এখানে একজন অগ্রণী ভাষাবিজ্ঞানীর মতামত একটু আগেই উল্লেখ করেছি৤ তিনি বলেছেন-- তখনকার স্কুলের ব্যাকরণে প্রায় ধরেই নেওয়া হত যে, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত থেকে বানানসুদ্ধ ধার-নেওয়া ‘তৎসম’ শব্দ ছাড়া আর বাকি যা আছে, সে সব শব্দ জাতে খুব নিচু৤ কাজেই ব্যাকরণে তাদের খবর নেওয়ার দরকার নেই”(রবীন্দ্রনাথ যে ব্যাকরণ লিখতে চেয়েছিলেন-- পবিত্র সরকার৤ আজকাল, পৃঃ-ঘ, ০৮/০৫/১৯৯৪)৤ 

        হয়তো তাই! হয়তো তাই কেন, অবশ্যই তাই৤ বাংলা কি এত কালেও জাতে উঠেছে? পাঠক কী বলেন? বাংলা কি সব জায়গায় সাহস করে, জোর করে বলা যায়? অবশ্যই যায় না৤ যেমন যায় না সর্বত্র বাংলা বানান লেখা৤ বাংলা বানান লিখতে হলে সংস্কৃতের অনুমতি--Permission দরকার! অবশ্য কিছু এলেবেলে মানুষ অন্য কথা বলছে৤ তারা  বাংলা বানান বাংলা করেই লিখতে চাইছে৤ কিন্তু সে সাধ তাদের সাধ্যের মধ্যে কি? বাংলা নতুন-বানান নাহয় তাদের শিরোভূষণ, কিন্তু সেই বাংলাকে তারা অন্যদের শিরোধার্য করাতে পারবে কি? এক বারে না হোক ৯ বারে হতে পারে, ৯ বারে না হোক শত বারে হবে, চেষ্টা করতে দোষ কী? মানুষের আত্মবোধ তো যেকোনও সময়েই জেগে উঠতে পারে৤ 

        ভাষা হল জীবন ও জীবিকার মূল হাতিয়ার৤ মাতৃভাষাকে এড়িয়ে সেই হাতিয়ারকে অন্য ভাষার হাতে তুলেদেওয়া কোনও কাজের কথা নয়৤ সংস্কৃতের সম্পদ আমাদের ভাষার সমৃদ্ধি ঘটাবে যদি আমরা তা থেকে ঠিক মতো সম্পদ সংগ্রহ করতে পারি৤ সেই সম্পদ সংগ্রহ না-করে, যদি আমরা ভাষা চাপা পড়ি, তবে তা আমাদের কোন্‌ গন্তব্যে পৌঁছে দেবে? 

        ভাষা-- আমাদের জীবন ও জীবিকার মূল হাতিয়ার হলেও ভাষার বানান ব্যবহার হল একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি৤ তাই তা আর তো লোকের উপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না৤ সে জন্য ভাষা ব্যবহারকারীদেরই ভেবে দেখতে হবে যে কোন্‌ পথে চললে তাতে তাদের সর্ববিধ মঙ্গল হবে৤ 



 

        সংস্কৃত একটি অতি উন্নত ভাষা৤ বলা হয়েছে, ‘Perfect’ language, for all time এবং তার কাছে বাংলাভাষীদের ঋণ অপরিমেয়৤ কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা চিরকালই তার আঁচল ধরে চলব৤ বাংলাভাষীদের এবার একটু নিজের পায়ে, নিজের মেরুদণ্ডের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে৤ লতানে গাছ হয়ে আর কতকাল তার হামগুড়ি দেওয়া চলবে? বাঙালিদের শৈশব যে আর কাটতেই চায় না৤ এক কালে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বলেছিলেন যে, বাঙালির সকল পড়াশুনা বাংলা ভাষায় হবে৤ তখন চারিদিক থেকে হায় হায় রব উঠেছিল৤ মনে হয়েছিল যে, লেখা পড়া বুঝি রসাতলে গেল৤ কিন্তু তা যে যায়নি, এখন তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৤ এখন ছেলেমেয়েরা তাদের মাতৃভাষা বাংলায় লেখাপড়া করে অনেক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে৤ বাংলা বানান নিয়ে আজ যে দ্বন্দ্ব দ্বিধা তাও অবশ্যই ভবিষ্যতে কেটে যাবে, কিন্তু এই মুহূর্তে এই দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওঠা একটু কঠিন বই-কি৤ যাঁদের সে দুর্বলতা আছে, তাঁরা না হয় একটু চুপ করে বসে দেখুন ব্যাপারটা কী হয়? ১৮৬৫-তে একজন বিদেশি(ইংরেজ পাদরি) জন মারডক বাংলা ছাপাখানার টাইপ বা বাংলা হরফ একটু সরল করার আবেদন করেছিলেন, কারণ তিনি স্কুলের পাঠ্যবই প্রকাশনায় দীর্ঘকাল জড়িত ছিলেন৤ বাংলা লেখার 


পালটে দেবার কথা তিনি বলেছিলেন, বলেছিলেন সহজ সরল করে যুক্তবর্ণ লেখার কথা৤ যেমন-- 
 (এখন তো এসব লিখতে গিয়ে একটু সরল করে-- চিন্তা, বন্ধু, উল্কা লেখা যাচ্ছে)৤ তাঁর সে কথায় কেউ আমল দেননি৤ তিনি সেকথা জানতেন যে এসব মানা হবে না, তাই তিনি একথাও বলেছেন--"Though the proposal may now be treated with ridicule(উপহাস), its adoption is a mere question of time." (দেখুন পূর্বোক্ত নিবন্ধ, পৃঃ-১০১)৤ আজ একটু একটু করে আমাদের সেদিকে এগোতেই হচ্ছে-- বলা যায় আমরা পরিস্থিতির চাপে সেদিকে এগোতে বাধ্য হচ্ছি৤ দেড়শো বছর আগে করলে যেটা আমাদের সুবুদ্ধিরই পরিচয় দিত৤ হয়তো বাংলা লেখাপড়া সহজ হয়ে বাঙালির জাগরণ এমন হত যে, এর দৌলতে আরও দু-একটা নোবেল বাংলার ঘরে আসত, কিন্তু তা হয়নি৤ সেযুগে বাংলার নবজাগরণের যুগেও(রেনেসাঁস) সে নব্যচিন্তা কাজে লাগানো গেল না? (ইংরেজিতে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে যে বাংলা ব্যাকরণ বই[A Grammar of the Bengal Language- by Nathaniel Brassey Halhed]) বের হয়, তাতে বাংলা উদাহরণ দেখাতে বাংলা বিচল হরফ(movable type) যা প্রথম ব্যবহার করা হয়, ছাপার সে টাইপ তৈরির ইংরেজ নির্দেশক বা নির্মাণকর্তা ছিলেন চার্লস উইলকিনস৤ দেশীয় কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে[কেউ কেউ বলেন এঁর পদবি ছিল মল্লিক] দিয়ে তিনি সে টাইপ তৈরি করান৤ প্রথম বাংলা সে টাইপ ছিল অনেকটাই সরল প্রকৃতির, সে প্রাবণতা অনুসরণ করলে আজ বাংলা ছাপাখানা নিয়ে এই এতকাল পরেও হা-হুতাশ করতে হত না)৤ 

          সেযুগে (হিন্দু)ধর্মের বাঁধ ভেঙে গো-মাংস খাওয়া গেল, ডিরোজিও, মধুসূদন, ইয়ংবেঙ্গলেরা এলেন, কিন্তু ভাষার বিকাশের স্বার্থে প্রাচীন ব্যবস্থা ভাঙা গেল না? সেযুগে মুদ্রণ-ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগরের প্রভাব ছিল অপরিসীম, তাই জন মারডক, বাংলার মুদ্রণ-নিয়ন্তা বিদ্যাসাগরের কাছেই তাঁর চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন৤ কিন্তু বাংলা মুদ্রণ-ব্যবস্থা বিদ্যাসাগরের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি৤ এই কিছুদিন আগেও ছাপাখানায় চলত বিদ্যাসাগরী (টাইপ)সাঁট৤ এখন এযুগেও তা রক্ষণশীলদের হাতে পড়ে প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে৤ এমনকী একটি কাগজ তো সাধুভাষায় সম্পাদকীয় লেখা এখনও ছাড়তে পারেনি৤ সেযুগে রক্ষণশীলতা ভাঙা না গেলেও এযুগে মানসিক বিকাশ ও বিশেষ করে কারিগরি বিকাশের প্রয়োজনে, ও প্রতিযোগিতায় পড়ে বাংলা ছাপাখানায় বিপুল পরিবর্তন এসেছে৤ তা বানান, এবং যুক্তবর্ণের সংযোজন/সংগঠন প্রক্রিয়া ইত্যাদিতে জোরালো প্রভাব ফেলেছে৤ হরফ সংযোজন সম্পর্কিত বাংলা ছাপার ব্যবস্থা দ্রুত পালটে যাচ্ছে৤ তাই, বাংলা নতুন-বানানের ব্যাপারেও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা যায়, its adoption is a mere question of time, যদিও সেটা হয়তো বহুজনের সম্মিলিত চিন্তা থেকে উঠে আসা প্রস্তাব মোতাবেক হবে, কিন্তু তা হবেই৤ 


 

        বাংলাভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব বেশি পড়তে আরম্ভ করে চৈতন্যোত্তর যুগে, তাঁর জীবনীকারদের হাতে৤ ফলে তখন বাংলা বানানেও সংস্কৃত বানানরীতি অপরিহার্য হয়ে ওঠে৤ এব্যাপারে মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া বলেছেন, চৈতন্যসাহিত্য[চৈতন্যদেব ১৪৮৬-১৫৩৩] বাংলাভাষায় যে কেবল জীবনচরিত লেখার প্রবর্তন করল, তা-ই নয়, ভাষার ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা বানানেও সর্বপ্রথম বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করতে লাগল৤ এর প্রধান কারণ এই যে, চৈতন্যচরিতকারের সকলেই সংস্কৃত ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন৤ সেজন্য বিশুদ্ধ সংস্কৃতশব্দের ব্যাপক ব্যবহার ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাদের যত্ন ও চেষ্টা স্বাভাবিক৤ এভাবে ভারতচন্দ্র রায়ের[১৭১২-৬০]আবির্ভাবের পূর্বেই সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা বাংলাভাষায় বিশেষভাবেই বিস্তৃতি লাভ করেছিল৤(বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠসমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৮৪, পৃঃ-৮৮)৤ অর্থাৎ চৈতন্যের জন্মের দুশো বছরের মধ্যে বাংলা বানান সংস্কৃতানুসারী হয়ে ওঠে৤ এর ফল দুরকম-- (এক) বাংলা বানানে যথেচ্ছাচার কিছুটা কমল, যে যার ইচ্ছে মতো বাংলা বানান লিখতে পারলেন না, (দুই)সংস্কৃতভাষায় অনভিজ্ঞ মানুষ বাংলা বানান নিয়ে হিমসিম খেতে লাগলেন৤ 

        জীবন তার নিজের বেগে আপন গতিতে চলবে৤ সে এগিয়ে যাবে, বাধা দিয়ে তাকে আটকে রাখলে তার অগ্রগতি কমে যাবে, অর্থাৎ আমাদের নিজেদের জীবনের গতি স্তিমিত হবে-- অন্যেরা, অন্য ভাষাভাষীরা হয়তো তখন আমাদের টপকে অনেক এগিয়ে যাবে৤ প্রতিবেশী অন্য ভাষার প্রবল চাপে পড়ে আমরা কি নিত্য তা অনুভব করছি না? যদি সত্যিই তা অনুভব না করি, তবে বুঝতে হবে আমরা এক অনুভূতিহীন জড় জাতিতে পরিণত হয়েছি৤ 

        তবে এখানে একটা কথা আগেই বলে রাখি৤ বাংলা বানানকে নতুন পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ বাংলা করে লেখা হবে, এ কথার মানে কিন্তু এই নয় যে, কাল সকাল থেকেই সকল শব্দের বানান পালটে-টালটে হঠাৎ একেবারে সব নতুন করে লিখতে শুরু করা হবে৤ না, সে রকম করলে বাংলা ভাষাটা লোকের কাছে অপরিচিত অদ্ভুত এবং নতুন ঠেকবে৤ বাংলা বানান এক দিনে সব পালটে-টালটে একেবারে মহা বিপ্লব বাধিয়ে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়৤ তেমন করা হবেও না৤ বরং অতি ধীরে জীবনের তাল ও লয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা বানানের পরিবর্তন করা হবে৤ লোকে সে পরিবর্তন যেন অতি সহজে বুঝতে পারেন, এবং এ ব্যাপারে যেন তাঁদের মানসিক অনুমোদন থাকে৤ তবেই বাংলাভাষাকে নিয়ে সবার সঙ্গে একত্রে এগিয়ে যাওয়া যাবে৤ 

        প্রথমে যে পরিবর্তন করা হবে, তা হবে অতীব সামান্য৤ যা লোককে ধাক্কা দেবে না, বরং লোকেরা নিজেরাই তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন৤ বাংলা বানান-সংস্কার প্রকল্পটির সময়পর্ব হবে দীর্ঘ ২৫ বছর৤ ২৫ বছর ধরে একটু একটু করে অতি ধীরে কাজটি সারতে হবে৤ 

        বাংলা বানান সংস্কারের পুরো প্রকল্পটি প্রথমে ছকে নিতে হবে, তারপরে তার কোন্‌ অংশটি থেকে প্রয়োগ শুরু করতে হবে তা ঠিক করতে হবে৤ পুরো প্রকল্পটি খুব বিস্তারিতভাবে এখানে উপস্থাপিত না করে সংক্ষেপে তা হাজির করার চেষ্টা করছি৤ বিস্তারিত প্রকল্পটি “সাহিত্য ও সংস্কৃতি” ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (বাংলাভাষা পরিকল্পনা, জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৯০, ২৫বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, পৃঃ ৪২৮-৪৩৮)৤ 

 ১০

        বাংলায় স্বরবর্ণ আছে ১১টি৤ তার মধ্যে আমরা ব্যবহার করি মাত্র ৬টি, বাকি ৫টি আমরা বস্তুত ব্যবহার করি না৤ বরং বর্ণমালায় নেই, এমন একটি বর্ণ আমরা ব্যবহার করি৤ সেটি হল-- ক্যাট[cat], ব্যাট[bat]-এর এ্যা/অ্যা(Æ=A+E, æ=a+e) ধ্বনি৤ এটি এসেছে প্রধানত ইংরেজির প্রভাবে৤ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা বর্ণমালা সবটা ঠিক নেই৤ সংস্কৃত বর্ণমালার অপ্রয়োজনীয় অবশেষ(তলানি) বাংলায় এখনও অনেকখানি রয়ে গেছে৤ অনেকটা যেন বহুদিন ধরে ফুটে থেকে বোঁটায় শুকিয়ে থাকা ফুল! এবং একটি ইংরেজি স্বরবর্ণ “এ্যা” এসে জুটেছে৤ (মনে হয় ‘এ্যা’ ধ্বনিটি প্রাক্‌-ইংরেজ যুগেও ছিল, পুরানো পুথি দেখে তেমনই মনে হচ্ছে)৤ তাহলে বাংলা স্বরবর্ণে বর্ণ সংখ্যা দাঁড়াল মোট ৭টি৤ এ কটিই বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনি/বর্ণ৤ তাই, বাংলা মৌলিক স্বরবর্ণগুলি হল-- অ আ ই উ এ এ্যা ও --এই ৭টি৤ 


এ্যা উচ্চারণের বর্ণরূপ হবে এ্যা=এা৤ 

অর্থাৎ বাংলা স্বরবর্ণ হল-- অ আ ই উ এ এা ও --৭টি৤ 

        যে-কটি স্বরবর্ণ আমরা ব্যবহার করি না, সেগুলি হল-- ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ৤ এই মোট ৫টি৤ এর মধ্যে ঐ ঔ হল যৌগিক স্বরধ্বনি৤ এছাড়া, আরও একটি স্বরবর্ণ বাংলায় আছে সেটি হল -- ঌ, দেখতে এটি সংখ্যা ৯(নয়-Nine)-এর মতো৤ এর উচ্চারণ -- লি৤ এসবই সংস্কৃত বর্ণমালা থেকে নেওয়া৤ অবশ্য বাংলা স্বরবর্ণমালা থেকে ঌ(লি), বোঁটায় শুকিয়ে থাকা ফুলের মতো, অব্যবহারে এক সময়ে আপনিই খসে গেছে৤ বাকি অ-ব্যবহৃত স্বরবর্ণগুলি সময়ের আবর্তে খসে পড়ার অপেক্ষায় আছে৤ হয়তো তা দশ বছরে খসে যাবে না, একশ বা দুশো বছর লাগতে পারে, বা তারও বেশি৤ তবে খসে তা যাবেই, কারণ যা অপ্রয়োজনীয় তা কতকাল মানুষ আর বয়ে বেড়াবেন? যেমন আমরা ঌ(লি) বয়ে বেড়াইনি, আমাদের অলক্ষ্যে কবে যে তা, ব্যবহার এবং বর্ণমালা থেকে খসে গেছে কে জানে? আমরা যদি ‘ঌচু’ লিখি তবে লোকে পড়বে ‘নয়চু’৤ বাংলাবর্ণমালা থেকে একটি বর্ণ ১৯৮১ নাগাদ প্রাথমিক শিক্ষার বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি হল অন্তস্থ-ব(= ৱ)৤  

         বিদ্যাসাগরের(১৮২০--১৮৯১) বর্ণমালায় ঌ(লি) ছিল৤ তিনিও এটি বর্জন করেননি৤ কিন্তু যা অপ্রয়োজনীয় অহেতু তা আপনিই এই সময়ের মধ্যে খসে গেছে৤ 

        তর্ক এখান থেকেই উঠবে৤ এসব বর্ণ যে আমরা ব্যবহার করি না, এসব কথা কে বলল? কে বলল যে এসব বর্ণ বাতিলযোগ্য? সে কথাই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করব, ধৈর্য ধরে তা একটু বোঝার চেষ্টা করতে হবে! 

        এসব প্রস্তাবের সবটা অবশ্য আমার একার নয়৤ পূর্বসূরিরা পৃথক পৃথক ভাবে অনেকে যেসব প্রস্তাব দিয়ে গেছেন আমি কেবল সেসব প্রস্তাব একত্র করে একটু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি৤ অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, আমি পূর্বসূরিদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজে নির্দোষ সাজার চেষ্টা করছি৤ বরং বলতে চাইছি, সঠিক যে-পথ তাঁরা দেখিয়ে গেছেন, আমি তাঁদের সে-পথ অনুসরণ করছি৤ যে অপ্রয়োজনীয় জগদ্দল এতকাল ধরে বাংলাভাষায় আমরা বয়ে চলেছি তাতে আমাদের গতি দ্রুত হতে পারে না, অগ্রগতি তো পরের কথা! 

        ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(১৮২০--১৮৯১, জীবনকাল ৭২ বছর) মহাশয় ৩৬ বছর বয়সে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথমভাগ প্রকাশ করেন কোলকাতা থেকে(বঙ্গাব্দ ১২৬২, ইং১৩ই এপ্রিল-১৮৫৫, ১লা বৈশাখ সংবৎ ১৯১২, সম্ভবত দিনটি ছিল বাংলা নববর্ষের পূর্বের দিন) তখন তিনি বাংলাভাষার সংস্কারও করেন৤ গ্রন্থ প্রকাশের সময়ে সে-গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি জ্ঞাপন করেন যে, “বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল৤” এযুগে বাংলা বর্ণমালায় আছে-- স্বরবর্ণ-১১, ব্যঞ্জনবর্ণ-৪০, এই মোট ৫১টি বর্ণ৤ এর থেকে বর্গীয়-ব এবং অন্তঃস্থ-ব(=ৱ) এই দুটির থেকে অন্তঃস্থ-ব(=ৱ) বাদ দিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১+৩৯=৫০টি৤ অর্থাৎ ১৬ স্বর, ৩৪ ব্যঞ্জন(মোট ৫০) এখন আর নেই৤ যদিও মোট সংখ্যায় তা একই আছে৤ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের ৪২ বছর আগে প্রথম বিচল হরফে বঙ্গের হুগলিতে ছাপা(১৭৭৮) বাংলা হরফের উদাহরণ দেখা যায় ন্যাথানিয়েল ব্যাসি হ্যালহেড লিখিত ইংরেজি বই A Grammar of the Bengal language-এ৤ সেখানে বাংলা বর্ণমালার যে উদাহরণ দেখানো আছে তাতে ১৬ স্বর, ৩৪ ব্যঞ্জন-ই আছে৤


১১

        বাংলা বর্ণমালর চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটেছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হাতে৤ বাংলা বর্ণমালার তিনি সম্যক উন্নতিসাধন করেন৤ তিনি বাংলা বর্ণমালা থেকে ৠ (দীর্ঘ-ঋ), এবং ৡ(দীর্ঘ-ঌ[দীর্ঘ লি])  বর্জন করেন৤ এছাড়া, অনুস্বর(ং), এবং বিসর্গ(ঃ) বর্ণদুটিকে স্বরবর্ণ থেকে এনে ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভুক্ত করেন৤ “আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়েছে৤ ড ঢ য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ, পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, ড় ঢ় য় হয়; ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে৤ কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পর ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত, উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে৤” হ্যালহেডের বইখানি থেকে দেখা যায় যে, বিদ্যাসাগরের আগে থেকেই বাংলায়  শব্দমধ্যে-- ড়, য়, ৎ ং ঃ ঁ  ইত্যাদির ব্যবহার ছিল, যদিও বর্ণমালায় তাদের স্থান ছিল না৤

        বাংলা বর্ণমালার যে কী ব্যাপক সংস্কার তিনি করেছেন তা আর বলার অপেক্ষ রাখে না৤  যেন সমুদ্র মন্থন করে তিনি মুক্তা তুলে দিয়েছেন বাংলাভাষীদের হাতে৤ আর তার উপর ভর করেই আমাদের এই অগ্রযাত্রা৤ যদি আমরা আমাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাই তবে, এযুগেও চাই আর এক বিদ্যাসাগর, তাঁর দেখানো পথে বাংলা বর্ণমালার আবার নতুন করে আমূল সংস্কার করতে হবে৤ 

        এই এতগুলি পরিবর্তন সাধারণ কারও পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, বিদ্যাসাগরের মতো স্থিতধী জ্ঞানী মানুষের পক্ষেই এটা করা সম্ভব হয়েছে৤ বলা যায় বাংলায় ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনা বিদ্যাসাগরের হাতেই শুরু হয়েছে৤ বাংলা বর্ণমালার ভিতরে যেসকল অ-প্রয়োজনীয় বর্ণ সংস্কৃত থেকে এসে বহুকাল ধরে জমা হয়ে বাংলাভাষাকে স্তিমিত অনুর্বর করে তুলেছিল, তা বিদ্যাসাগর দক্ষ হাতে সম্মার্জন করে বাংলা ভাষাকে গতিশীল প্রাণবন্ত জল-প্রবাহে পরিণত করেন৤ এই জন্যই অনেক বাঙালি মনে করেন যে, বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার জন্ম দেন৤ অর্থাৎ তাঁর হাতেই বাংলাভাষার জন্ম৤ এই মনে করাটায় বাড়াবাড়ি আছে ঠিকই, কিন্তু বিদ্যাসাগরকে এমন সম্মান আমরা বোধ হয় দিতেই পারি৤ (আমার ক্ষুদ্র বিদ্যা নিয়ে শিক্ষকতা কালে নিচু ক্লাসের একজন ছাত্রীকে তেমনি ধারণাই পোষণ করতে দেখেছি)৤

        বিদ্যাসাগর মহাজ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন, এযুগে হয়তো তেমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অতি কঠিন, কিন্তু এখনই বাংলা বর্ণমালার আমূল সংস্কার করা খুবই জরুরি৤ বিদ্যাসাগরের মতো মহাজ্ঞানী মানুষের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকার সময় নেই৤ বাংলাভাষার সংস্কার এখনই করা দরকার৤ তাই সাধারণ মানুষকেই যৌথ উদ্যোগে হাত লাগাতে হবে বাংলাভাষা সংস্কারের কাজে৤ কারণগুলি মোটামুটি এই :--

১)এখন মহাকাশ যুগ, আর জীবনের গতিকে অতি দ্রুত করে দিয়েছে কম্পিউটার৤ বিশ্বের অন্য সকল ভাষা ও জাতি দ্রুত এগোবে আর আমরা শ্লথ গতিতে চলে পিছিয়ে পড়ব, তা হয় না৤ তাই ভাষার গতি বাড়াতে বাংলাভাষার আশু সংস্কার করা দরকার৤ 

২)বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষা ক’টির একটি হল বাংলা৤ জনসংখ্যায়ও বাংলা বিশ্বে চতুর্থ থেকে সপ্তমের মধ্যে৤ কিন্তু অন্য আগ্রাসী ভাষার দাপটে বাংলা অস্থির, তার প্রাণ ওষ্ঠাগত৤ এই আগ্রাসন রুখতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাঙালির স্বাভাবিক সৌজন্য ও রুচি বোধ৤ বাংলাভাষার সংস্কার করে ভাষার গতি বাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারলে বাঙালির বর্তমান পশ্চাৎপদতা অনেকখানি কাটিয়ে ওঠা যাবে৤ কারণ ভাষা হল জীবন ও জীবিকার মূল হাতিয়ার৤ সেই হাতিয়ারকে আমরা যেমন হেলায় হারাতে চাই না, তেমনি সে হাতিয়ারকে অন্যের হাতে তুলেও দিতে চাই না৤ 


 ১২

৩)শিক্ষা মানুষের মূল মেরুদণ্ড, জাতিরও মূল মেরুদণ্ড৤ শিক্ষার মাধ্যম হল ভাষা৤ তাই ভাষা যত সহজ সরল অনায়াস এবং গতিশীল হবে, একটি জাতি ততো দ্রুত এগিয়ে যাবে৤ 

৪)বাঙালি বুদ্ধিমান জাতি, বাংলা ভারতের শ্রেষ্ঠ ভাষা, তবু যদি তার অগ্রগতি স্তিমিত হয়, তবে তা বাঙালির ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে৤ সুতরাং বাংলাভাষার অবস্থান এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যে, তা আপন গতিতে সবার আগে এগিয়ে চলবে৤ (পরে উল্লেখ করা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বাণী দ্রষ্টব্য, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ অংশে)৤

৫)বাংলাভাষাকে এখনও আমরা 

(ক)জীবিকার ভাষা, 
(খ)বাণিজ্যের ভাষা, 
(গ)বিনোদনের ভাষা, 
(ঘ)ভ্রমণের ভাষা 
(ঙ)কারিগরির ভাষা 
(চ)চিকিৎসার ভাষা 

করে তুলতে পারিনি৤ বাংলাকে শুধুমাত্র সাহিত্যের ভাষা, সংস্কৃতির ভাষা করে রাখলে চলবে না, বাংলাকে সর্বময় করে তুলতে হলে জীবিকা ও বাণিজ্যের ভাষা, বিনোদন ও ভ্রমণের, কারিগরির ও চিকিৎসার ভাষা করে করে তুলতে হবে৤ এটা আমাদের করতেই হবে, আর সে জন্যই দরকার বাংলাভাষার সুষ্ঠু সংস্কার৤ 

        এ উদ্দেশ্যেই চাই বাংলাভাষার জন্য 
(১)রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সমর্থন, 
(২)আর্থিক সমর্থন ও মদত, আর 
(৩)সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষণ যেমন চলছে তেমনি চলুক৤ 

        বলা হয় যে, সংস্কৃত হল পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষা(‘Perfect’ language, for all time)৤ যে-যুগে সংস্কৃতভাষা প্রচলিত ছিল, সেযুগে ভারতের সভ্যতা ছিল শিখরে৤ শিক্ষা সংস্কৃতিতে ভারত সবার থেকে এগিয়ে ছিল৤ ছিল বটে, কিন্তু সংস্কৃতভাষার জটিলতার জন্য শিক্ষার হার নিশ্চয়ই খুব নগণ্য ছিল৤ পণ্ডিতেরা বা দেশের শাসক রাজারা সেজন্য ভাবিত ছিলেন না৤ ভাষাকে সহজ সরল করে দেশে শিক্ষা বিস্তারে তাদের তেমন উদ্যোগ ছিল বলে মনে হয় না৤ আমরা এযুগেও কি সেযুগের রাজাদের মতো মনোভাব পোষণ করব যে, দেশের সাধরারণ মানুষের মধ্যে লেখাপড়ার প্রচলন হল কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই(বরং শিক্ষা বাড়লে চেতনা বাড়বে, দাবি দাওয়া, অধিকার নিয়ে প্রজারা ব্যস্ত করে তুলবে! এ যুগে ইংরেজরাও কি তা করেনি)? শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, আর সে শিক্ষার মাধ্যম হল ভাষা৤ তাই ভাষাকে শক্তিধর ও সর্বত্রগামী করতে হলে ভাষার বিকাশ ঘটানো দরকার-- যা হতে পারে ভাষার সুষ্ঠু এবং সদর্থক সংস্কারের মাধ্যমে৤ 

        বাংলাভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ, সুমধুর, সুরেলা ও ছন্দময় ভাষা ক’টির একটি হয়েও চাপা পড়ে আছে৤ বাঙালি পুরুষের পোষাক-- বিদেশি প্যান্ট শার্টে পৌঁছে গেছে আগেই, এখন বঙ্গ নারীর পোষাক অতি দ্রুত শালোয়ার কামিজ হয়ে উঠছে৤ বাঙালির পোষাক গেছে, খাদ্যও যায় যায়, কিন্তু ভাষা গেলে তার চলবে না৤ তাহলে বাঙালির জীবন জীবিকা ধ্বংস হয়ে বাঙালি এক ক্লীব জাতিতে পরিণত হবে৤ এখন ‘বাঙালি’ মানে হচ্ছে বোধহয়-- বিভাষায় পারঙ্গমতা দেখাতে অতি-ব্যস্ত একধরনের নিবীর্য পরগাছা-প্রায় ব্যক্তিত্বহীন মানুষ! একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ইতিহাস ঘেঁটে জানিয়েছেন, ‘বাঙালি’ কথাটার অর্থ হচ্ছে ‘ব্রাত্য’! তাই বাংলাভাষাকে সংস্কার করে সহজ সরল করে ‘বাঙালির’ কাছেই যদি তুলে ধরা না-যায়, তবে এক অকাল-মৃত্যু বোধহয় বাংলাভাষার কপালে নাচছে৤ বাংলাভাষার অস্তিত্বের প্রশ্নেই বাংলা ভাষার সংস্কার হওয়া দরকার৤ বাংলা বানান (প্রায়) যথেচ্ছভাবে লেখার চল আছে৤ আর তা হবার কারণ হল, সুষ্ঠু সংস্কার এবং রীতিনীতির অভাব৤ এই যথেচ্ছতা, কী ইঙ্গিত বহন করে? বোধ হয় তা প্রাণেরই লক্ষণ(৻), নয়তো আমাদের উদ্যোগ এতইবা ঘুমিয়ে কেন? 



 ১৩

        যাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেন তাঁরা জানেন এবং বোঝেন ইংরেজিতে টাইপ করা, এবং বাংলায় টাইপ করার মধ্যে ভীষণ তফাত৤ না, হরফের তফাতের কথা বলছি না, জটিলতায় বাংলা কিবোর্ড, ইংরেজি কিবোর্ডের কাছে গো-হারান হেরেছে৤ ইংরেজি যদি ১০০ পায়, বাংলা টাইপ সেখানে পাবে বড়জোর পাশমার্ক ৩০৤ বাংলার সমস্ত ব্যবস্থাপত্র এতই জটিল এবং এতই অসংগঠিত, এবং জগদ্দল যে, এর বিহিত-সংস্কার না হলে বাংলাভাষার বিপদ অবশ্যম্ভাবী৤ তবু আমাদের নিরুদ্বিগ্ন মনোভাব আমাদের অবিমৃশ্যকারিতারই পরিচায়ক৤ 

        কম্পিউটার চালনার ব্যবস্থায় DOS--Disk/Disc Operating System একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মূল(Fundamental) প্রকরণ৤ বেশ কয়েক বছর হল হিন্দিতে ডস্‌ DOS চালু হয়েছে৤ বাংলায় এখনও DOS চালু হয়নি(২০১৪)৤ কবে হবে তারও কোনও ঠিক নেই৤ বাংলাভাষার প্রতি আমাদের উদ্যোগ যত্ন, অভিনিবেশ, ভালোবাসা কতটা তা এর থেকে কিছুটা অনুমান করা যাবে৤ মুখে কেবল-- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, বহিরাগত অভিনেতা  অভিনেত্রীরা, গায়ক গায়িকারা এখানে এসে যেমন মুখস্ত এই বুলি বলে থাকেন! ভাবাবেগ প্রকাশেই কর্তব্য শেষ করলে হবে না৤ কিছু বাস্তব প্রয়াসও চাই৤ এ ব্যাপারে সরকারি, বেসরকারি বা বাণিজ্যিক কোনও উদ্যোগই তেমন চোখে পড়ছে না৤ 

        বাংলায় অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত বর্ণ বজায় রেখে আমরা বাংলাভাষার উপকার করিনি, বরং তা বাংলাভাষাকে জটিল এবং শ্লথ করে রেখেছে৤ এ ব্যাপারে আমাদের তেমন সচেতনতা নেই, বরং রক্ষণশীলতা আছে৤ এই প্রবল গতির যুগে সেই সব অকারণ রক্ষণশীলতা ঝেড়ে ফেলতে হবে, নয়তো আমরা অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিছুতেই পেরে উঠব না৤ মাথায় অকারণ হরফপাথরের বোঝা বয়ে অন্যদের সঙ্গে দৌড়ে পারা যাবে কি?  

        বাংলায় আছে ১১ স্বরবর্ণ, ৪০ ব্যঞ্জনবর্ণ৤ ১১ স্বরবর্ণের ৬টি আমাদের সত্যিকারের কাজে লাগে, সঙ্গে আর চাই একটি নতুন বর্ণ৤ বাকি ৫টি স্বরবর্ণ কেবল নানা বাধা এবং জটিলতা সৃস্টি করছে৤ তাই এই ৫টি স্বরবর্ণ বাংলা বর্ণমালা থেকে বাদ যাবে৤ বাতিল বর্ণগুলো হল-- ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ৤  

        যে স্বরবর্ণগুলি চালু থাকবে সেগুলি হল-- অ আ ই উ এ এা ও৤ মোট ৭টি৤ এা (তথা এ্যা Æ/æ) হল বর্ণমালায় নতুন সংযোজিত স্বরবর্ণ৤ Bat, Cat-এর এ্যা-ধ্বনি৤ প্রধানত ইংরেজির প্রভাবে৤

এা স্বরবর্ণটি প্রস্তাব করেছেন জ্ঞানচারী বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ৤

        বাতিল বর্ণগুলো-- ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ, সত্যিই কি আমাদের কোন কাজে লাগে না? এর জবাবে সহজেই বলা যায়-- এসব আমাদের সত্যিকারের কোন কাজে লাগে না৤ একটা কৃত্রিম প্রয়োজন দেখিয়ে, এসব আমাদের খুব দরকার, তা বোঝানোর চেষ্টা হয়৤ যেকোন কাজে নামলে যেমন বাধা সৃষ্টি করার এক প্রবণতা একদল মানুষের মধ্যে দেখা যায়, এখানেও তেমনি বাধা দেওয়া হয়, এবং অবশ্যই সে বাধা অতিক্রম করা খুবই কঠিন৤ কারণ, যে ব্যবস্থা চলছে তার কোন প্রকার ব্যতিক্রম কেউই চট করে মেনে নিতে চান না৤ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না৤ কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি৤...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে৤ যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয়৤ মতের অনৈক্যে রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার৤" 

        এজন্য নানা সূক্ষ্ম কারণ তো দেখানো যায়ই, অনাবশ্যক কারণও অনেক দেখানো যায়৤ কিন্তু এসব তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে, নতুন প্রস্তাবিত পথ এবং পদ্ধতি আমাদের প্রকৃত কোন কাজে লাগছে কিনা? যদি লাগে তবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে নতুন পথকেই গ্রহণ করতে হবে৤
       


 ১৪
        

         বাঙালি ধুতি ছেড়েছে, শাড়ি প্রায় ছাড়ি ছাড়ি-- তাতে তার সুবিধা যে হয়েছে সেকথা মানতে হবে, তবে শালোয়ার কামিজ ব্যবস্থায় শাড়ির অসুবিধা তেমন দূর হয় না, তার চেয়ে বরং মেয়েদের শার্টপ্যান্টই ভালো৤ পোষাকে নতুনত্ব বজায় রেখেই বাঙালি চলবে, কিন্তু বাঙালি কখনও বাঙালিত্ব ছাড়বে না৤ ভাষা এবং সংস্কৃতি দুটোই ছাড়লে তখন আর কি বাঙালিত্ব থাকে? তা হলে তো সেই গল্পের মতো বলতে হয়, খোল আর নলচে বদলে হুঁকোর উত্তরাধিকার বজায় রাখা! বাংলাভাষার অভ্যন্তরস্থ জড়ত্ব বাঙালি বর্জন করবে, বাংলা ভাষাকে নয়৤ কোরিয়ার লোকেরা তাঁদের ভাষার যে আমূল সংস্কার করেছেন, তা অতুলনীয়৤ পারলে বাংলাভাষারও তেমন ব্যাপক পরিবর্তন করা দরকার৤ 
সে নতুনত্ব-- বাংলাভাষায় নতুন প্রাণ আনবে৤ যাহোক, যতটুকু করলে বাংলাভাষা প্রকৃতই “বাংলাভাষা” হয়ে উঠবে, ততোটুকু পরিবর্তন করারই প্রস্তাব এখানে করা হয়েছে৤ 

        কোরিয়ার লোকেরা তাঁদের ভাষার আমূল সংস্কার করতে গিয়ে কী করেছেন তা শোনা যাক--“The writing problem in the Republic of Korea has been  solved, and typewriters have been devised for writing with a horizontal left-to-right  adaptation of the traditional alphabet. It is supposed to be ‘so highly scientific in principle  that even the International Phonetic Symbols have to bow before the Korean alphabet’  (John Starr Kim, in ‘Ink-Remington Rand’ vol. III, no.4, September 1947. Mr. Kim was  one of the technicians who developed the Korean typewriter Keyboard). Formerly, the  alphabet– which was invented in A.D. 1446 by king She-Jong– was used vertically in columns from right to left in conglomerated syllabic units imitating Chinese characters.”(p-34) --The use of vernacular language in educationUNESCO, Paris-1953.


        কোরিয়া থেকে আমাদের দেশে কম্পিউটার এবং মোবাইল পার্টস এবং ইলেকট্রনিক জিনিস আসে৤ বিজ্ঞানে তাঁরা যে উন্নতি করেছেন সেটা এমনি হয়নি৤ যাঁদের ভাষা উন্নত তাঁরা দ্রুতই এগোন৤

        এখানে কেউ হয়তো তর্ক তুলবেন যে, কেউ তাদের ভষায় লেখার ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেছেন বলে আমাদেরও করতে হবে, এমন কোনও কথা আছে কি? তার জবাবে সবিনয়ে বলি, সেরকম উদ্দেশ্যের দিকে চোখ ফেরানো আমাদের লক্ষ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য এই কথা বলা যে, আমরা একারাই এ পথের পথিক নই, আমরা পাইয়োনিয়ারও নই৤ 

        এমনকি যে-ভাষার দোহাই পেড়ে বাংলাভাষার সংস্কারকাজ আটকাবার চেষ্টা করা হয়, সেই সংস্কৃত ভাষারই তো আমূল সংস্কার করা হয়েছে, আর সে জন্যই তো সেই প্রাচীন  বৈদিক ভাষা’টির নাম হয়ে যায় সংস্কৃত ভাষা, অর্থাৎ সংস্কারকৃত ভাষা৤ সংস্কার কাজটি করেছেন পাণিনি, তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের মাধ্যমে৤ সংস্কৃত শব্দের বানান নির্ভর করে তার বর্ণধ্বনির উপরে, বাংলায় সেটা হলে দোষ হবে কেন? বাংলাভাষা সংস্কার করার বেলায় কেন গাঁইগুঁই করা, বাধা দেওয়া? ভাবখানা বা ভয় এই যে, এতে বুঝি বাংলাভাষা রসাতলে যাবে৤ 


        না, এতে বাংলাভাষা রসাতলে যাবে না৤ কেবল আমাদের পাঠ-অভ্যাসটি অনেকটা পালটাতে হবে৤ প্রধানত সেই ভয়েই সংস্কার করতে না-চাওয়া৤ ধরি, একজন চুল দাড়িওলা সাধুকে হঠাৎ যদি দাড়ি চুল কামিয়ে কৌপিন ছাড়িয়ে প্যান্টশার্ট টাই পরানো হয়, তবে ব্যাপারটা আমাদের চোখে খুব লাগবে৤ কারও কাছে তা খারাপ, আবার কারও কাছে ভালো৤ অভ্যাসের অন্যথা হলেই তা আমাদের অসুবিধাজনক মনে হয়৤ কিন্তু ভাষার শ্লথ গতি এবং দুর্দশা আমাদের কাছে অসুবিধাজনক মনে হয় না কেন? ভাষার দুর্দশা ঘোচাবার জন্য আমাদের অভ্যাস পালটাতে হবে৤ সেটা না করলে আমরা ক্রমে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ব৤ পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ ভাষাকে আমরা তা হতে দিতে পারি না৤



        ১৫

        যাহোক, মূল আলোচনায় আসি৤ সংস্কার করার পরে বাংলা স্বরবর্ণে থাকবে ৭টি স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণে থাকবে ৩৫টি ব্যঞ্জনবর্ণ৤ বাংলা বর্ণমালা হবে এই মোট ৪২টি বর্ণে গঠিত৤

        নতুন স্বরবর্ণ হবে-- অ আ ই উ এ এা ও -- ৭টি৤
        বাতিল হবে-- ঈ ঊ ঋ ঐ ঔ (৫টি)৤

নতুন ব্যঞ্জনবর্ণ হবে --
ক খ গ ঘ ঙ
চ ছ জ ঝ *
ট ঠ ড ঢ *
ত থ দ ধ ন
প ফ ব ভ ম
* র ল * শ
* স হ ড় ঢ়
য় ৎ ং ঃ ঁ     --- এই ৩৫টি৤

        বাতিল হবে -- ঞ, ণ, য, অন্তঃস্থ-ব(ৱ), ষ  (৫টি)৤ 

স্বরবর্ণ থেকে বাতিল ৫টি বর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে বাতিল ৫টি বর্ণ৤ বাংলা বর্ণমালা থেকে বর্জিত হবে এই মোট (৫+৫=) ১০টি বর্ণ৤

নতুন বর্ণমালা হবে ৭+৩৫=৪২ বর্ণে গঠিত৤ (৫১-১০=৪১+১)

        এর প্রতিটি বর্ণ এবং আনুষঙ্গিক আরও বহু বহু বিষয় নিয়ে অতি দীর্ঘ আলোচনা করা দরকার৤ তা না হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে না, বরং ঘোলাটে হয়ে হয়তো আরও জটিলতা সৃষ্টি করবে৤ একজন আগ্রহী পাঠক আমাকে দীর্ঘ আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন৤ এখানে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশগুলি আলোচনা করা যাক৤

        বাংলা বানানে সবচেয়ে বেশি ভুল হয় ‘ই’ এবং ‘ঈ’-এর ব্যবহার জনিত কারণে৤ তাই নতুন ব্যবস্থায় সর্বদা ‘ই’ এবং ি (হ্রস্ব ই-কার) চিহ্ন ব্যবহার করা হবে৤ আর ‘ঈ’ এবং ী (দীর্ঘ ঈ-কার) চিহ্ন বর্জন করা হবে৤ 

        কেন ‘ঈ’ বর্ণ এবং “ী” চিহ্ন বর্জন করা হবে? তার মোদ্দা কারণ হল বাংলায় বর্ণ নেই৤ ঈ হরফটি বাংলায় ব্যবহার করা হয় বটে কিন্তু তার প্রকৃত অস্তিত্ব(তথা ধ্বনি বা উচ্চারণ) বাংলায় নেই৤ কথাটা অনেকের কাছে তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না৤ ধ্বনি বা উচ্চারণই হল বর্ণের প্রাণ, তথা বর্ণ৤ আমরা বাংলায় অন্য বেশ কিছু ধ্বনি বা বর্ণ ব্যবহার করি, যেমন এা(Æ=A+E, æ=a+e) ধ্বনি৤ এর প্রয়োগ দেখা যাবে-- এাক=১, এাকা; এবং জেড(z) ধ্বনি জ় দেখি(মজা করে লেখা) Kidz কিডজ়, Newz নিউজ় ইত্যাদিতে৤ কিন্তু তার লিপি ব্যবহার করি না, কারণ তার লিপি বাংলায় নেই৤ জ-এর তলায় বিন্দু বসিয়ে জ় লিপিটি নতুন তৈরি করে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে৤ যেমন আছে র ড় ঢ় য়৤ 

         আবার উলটো দিকে তেমনি অনেক লিপি আমরা বাংলায় ব্যবহার করি কিন্তু তার ধ্বনি বা বর্ণ বাংলায় নেই৤ 


   অর্থাৎ (১)বাংলায় লিপি আছে বর্ণ নেই, আবার (২) বর্ণ আছে লিপি নেই, এমন উদাহরণ দেখা যাবে৤ 



 ১৬

        লিপি কাকে বলে?
        লেখার জন্য যে হরফ তথা চিহ্ন  আমরা ব্যবহার করি তা-ই হল লিপি৤ যেগুলি আসলে শুধুই ছবি৤ 
        আর যে-ধ্বনি আমরা উচ্চারণ করি তার লিখিত রূপ(লিপি, তথা ছবি) হল বর্ণ৤ 
        যে লিপির উচ্চারণ নেই তা কেবলই ছবি৤ প্রাণহীন ছবি৤ উচ্চারণই লিপির প্রাণ, উচ্চারণই লিপির ছবিকে বর্ণে উত্তীর্ণ করে৤ তাই, ঈ ঊ ঋ --লিপিক’টি কেবলই ছবি, তা বর্ণ নয়৤ লিপিকে আমরা হরফ, অক্ষর ইত্যাদিও বলি৤ লিপিকে আমরা বর্ণ বলেও জানি,  কিন্তু লিপি মাত্রেই বর্ণ নয়৤ যেমন ঈ হরফ/অক্ষর/লিপিটি বাংলা বর্ণ নয়৤ ঌ লিপিটি নিয়ে এখন যে সমস্যা সেটা খেয়াল করলে এটা বেশ বোঝা যাবে৤ ঌ-এর লিপিটি এখনও লোকে কেউ কেউ চেনেন, তার ধ্বনি অন্তর্হিত৤ অর্থাৎ এটির ধ্বনি মুছে যাওয়ায় তার লিপি-অস্তিত্বও মুছে গেছে৤ 

          একজন ভাষাবিদ বলেছেন যে-- “এক একটি ধ্বনিবর্গের প্রকাশ এক একটি বর্ণের মাধ্যমে৤ ... প্রত্যেক ধ্বনির জন্য বর্ণ বরাদ্দ করা কখনোই সম্ভব নয়, কোনো ভাষাতেই তা করা হয় না৤ ...ধ্বনি অগুনতি, বর্ণ গোনাগুনতি৤”(পলাশ বরন পাল-- ধ্বনিমালা বর্ণমালা, পৃঃ ২৬, ২৫)৤  

        এ নিয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক৤ এতে আমাদের ধারণা খানিকটা স্পষ্ট হতে পারে৤ যেমন--
 খেয়েছ?  
(হ্রস্ব আ) 





খেয়েছ?
 

(সাধারণ আ)


খেয়েছ?


(দীর্ঘ আ)


খেয়েছ?



(প্লুত আ )
       
সাধারণ লেখায়, এভাবে কি বানান লিখে-- অতি বিস্তৃত বানান দেখানো হবে, বা দেখানো যাবে? হ্রস্ব-ই এবং দীর্ঘ-ঈ(ই ঈ)-এর ব্যাপারটাও এমনি৤ এসব কি সাধারণ লেখার বানানে দেখানো হবে, বা দেখানো যাবে? হ্রস্ব-ই এবং  দীর্ঘ-ঈ(ই ঈ) সংগীত এবং আবৃত্তিতে আছে৤ এখানে যেমন হ্রস্ব আ, সাধারণ আ, দীর্ঘ আ, এবং প্লুত আ ধ্বনির উদাহরণ দেখানো হয়েছে, সেটিও তেমনি৤ লেখায় তা দেখানোর দরকার নেই৤ 
        আবার উল্লেখ করা যাক, “...প্রত্যেক ধ্বনির জন্য বর্ণ বরাদ্দ করা কখনোই সম্ভব নয়, কোন ভাষাতেই তা করা হয় না৤ ...ধ্বনি অগুনতি, বর্ণ গোনাগুনতি৤” 

        সাধারণ লেখাপড়ায় এবং বলায় দীর্ঘ-ঈ নেই৤ সংগীতে কড়ি, কোমল, মীড় আছে, সাধারণ লেখায় তা নেই৤ একজন উচ্চাঙ্গ সংগীত গায়ক সুরের যে অতি সূক্ষ্ম ওঠানামা বোঝেন এবং ব্যবহার করেন, সাধারণ মানুষ তথা অ-গায়কদের সেসবের কোনও প্রয়োজন আছে কি? 

        কলের ভোঁ বাজে এক মিনিট ধরে, সেই ভোঁ বোঝাতে কতগুলো ও-কার(ো)দেওয়া হবে? ক-টা ও-কার দিলে এক মিনিট হবে? অতীব সংগীত প্রতিভাসম্পন্ন গোঁ-গোঁ শব্দকারী টেবল্‌ ফ্যানটার কয়েক ঘণ্টাব্যাপী গোঁ---ো৺ বোঝাতে কত হাজার ও-কার দেওয়া দরকার? 

        যে-দুটি ধ্বনির মধ্যে উচ্চারণগত প্রকৃত পার্থক্য নেই, সেখানে কেবল হরফ দিয়ে তা বোঝানো যাবে না কোন্‌টা কোন্‌ ধ্বনি৤ যেমন-- এদিকে তাকা, এবং এদিকে টাকা, কথা দুটির মধ্যে তাকা এবং টাকা-র পার্থক্য বাঙালিরা সহজে বুঝবে, কিন্তু ইংরেজ, আমেরিকান, বা ফরাসিরা বুঝবে না৤ এই বর্ণদুটির ধ্বনি-পার্থক্য তাদের কানে ধরা পড়বে না৤ দুটি পৃথক লিখিত হরফ ত, ট দেখলেও তার পার্থক্য তাদের হৃদয়ঙ্গম হবে না৤ ঠিক তেমনি ই এবং ঈ-এর পার্থক্য আমাদের কানে ধরা পড়ে না৤ ঠিক এ কারণেই এরা আমাদের বর্ণ নয়৤ 



১৭

        ব্যাপারটা বুঝতে পারিনা বলেই, কথাটা বিশ্বাস করাই কঠিন! (ইংরেজ, আমেরিকান, বা ফরাসিরা যেমন ত, ট পার্থক্য বুঝতে পারে না৤ আমরা যে এই সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝি সেটা তাদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন! নদীর তট তাদের কাছে অধরাই থেকে যায়৤ এটা তাদের কাছে ‘টট’)৤ লিখিত লিপিচিত্র দেখে দেখে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে বলে আমরা ধরে নিই, বা মনে করি যে এসব বাস্তবে সত্যিই বুঝি আছে৤ 

        দৃশ্যচিত্র বা ছবি, অর্থাৎ হরফ লিখিত বলে কেবলমাত্র চোখে ধরা পড়ে৤ আমাদের ধ্বনিভাণ্ডারে এ দুটি ধ্বনি(ই, ঈ) মৌলিক-ধ্বনি হিসেবে আসলে নেই যে, তাই ধ্বনির পার্থক্য বুঝতে না-পারা কোনও অক্ষমতা বা অপরাধ নয়, সুতরাং এ দুটি ধ্বনির পার্থক্য না বোঝায় পাপবোধ করার কোনও কারণও নেই৤ এই ধ্বনি দুটি-- পৃথক ধ্বনি হিসেবে সাধারণ বাঙালির কানে ধরা দেয় না৤ যেমন ইংরেজ, আমেরিকান, বা ফরাসিদের কানে ত, ট ধ্বনির পার্থক্য ধরা দেয়া না৤ কারণ এসব ধ্বনি তাদের ভাষায় নেই যে৤ ই-ঈ ধ্বনি-পার্থক্যও আমাদের বাংলা ভাষায় নেই, তাই তা আমাদের কানে ধরা দেয় না৤ 

        যে-ভাষায় যে-লিপির ধ্বনি নেই তাকে আর সেই ভাষার “বর্ণ” বলা যায় না৤ এজন্যই ঈ ঊ ঋ, কিংবা ঞ ণ য, অন্তঃস্থ-ব(ৱ), ষ ইত্যাদি বাংলার বর্ণ নয়৤ এ কেবল সংস্কৃত থেকে আগত বাংলায় অবস্থিত প্রাণহীন লিপি৤ ধ্বনিই লিপির প্রাণ, যা তাকে “বর্ণ” আখ্যা দেয়৤ ঈ ঊ ঋ, কিংবা ঞ ণ য, অন্তঃস্থ-ব(ৱ), ষ ইত্যাদি লিপি একারণেই বাংলার বর্ণ বলে গণ্য হবে না৤ এগুলি হল সংস্কৃত থেকে আসা বাংলার ভাঁড়ারে জমা থাকা নির্জীব হরফ-তাল মাত্র৤ 

        প্রাচীনকালে মিশর দেশে ছিল চিত্রলিপি৤ সব লিপিই আসলে ছবি৤ হরফের ছবি৤ সেখানে যেমন সিংহের ছবি 


 এঁকে বোঝানো হত ‘ল’ বা L ধ্বনি, 



যেমন --

  ক্ল KL 
  
         

        বাংলায় শব্দমধ্যে সিংহ এঁকে কি ল-ধ্বনি বোঝানো যাবে? বোধহয় যাবে না, কারণ সিংহের ছবি আমাদের কাছে কেবলমাত্র ছবিই, তা কোন ধ্বনি-বার্তা বহন করে না৤ প্রাচীন বাংলায় ঌ কেবলমাত্র সংখ্যা বোঝাতো না, এটি একটি অন্য ধ্বনিও বোঝাতো, তাহল-- স্বরধ্বনি ঌ(লি)৤ 

        লিচু যদি ঌচু লেখা হয়, তবে তা ‘নয়চু’ হয়ে উঠবে! লি(ঌ) হরফ/অক্ষর/লিপিটির এখন আর কোনওই বর্ণমূল্য নেই৤ ঠিক যেমন-- এক গণ্ডা, দু গণ্ডা কিংবা এক কড়া, দু কড়া বললে আজ আর কোনও অর্থমূল্য বহন করে না৤ এটা যে কী, সেটাই আজ বোঝা যাবে না৤ 

        প্রাচীন দিনে প্রায় 


(ঙ্গ) 



ধরনের রূপটি ব্যবহার করে অন্তত ৮ রকম বর্ণসংযোগ বোঝানো হত-- 

এই কথাটি আসলে হবে--

সঙ্গহীন ঈগল বিশুদ্ধ কুশ মুখে বিজ্ঞের মত নিরুদ্দেশ হল৤


=ঈ, কু, কৃ, গ্গ, ঙ্গ, জ্ঞ, দ্দ, দ্ধ (৮) আট রকম৤




এখন 

’ 
ধরনের আকৃতিটি বা রূপটি আর তার সেই আগের অবস্থানে নেই৤  



        অবশ্য এসব বললেও, বা বোঝা গেলেও, তা মনের দিক থেকে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন কাজ বইকি! ঠিক যেমন ছেলেবেলায় শোনা ভূতের গল্প আমাদের মনের মধ্যে এমন গেঁথে গেছে যে, কেবল যুক্তি দিয়ে ভূতের সে অবচেতন বিশ্বাস তাড়ানো কঠিন৤ ভূত আমরা  বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় করি! তেমনি ঈ-স্বরবর্ণ নেই, এটা আমরা কোনও প্রকারে মেনে নিলেও সেটি বর্জন করার সাহস দেখাতে পারব না৤ সে সাহস অর্জন করতে হলে তাই একটু বেশ জোর করতে হবে-- নিজের উপর নিজেই! নচেৎ তা ভূতের ভয়ের মতোই মনের গহনে গেঁথেই থাকবে৤ 




 ১৮


        বাংলায় দীর্ঘ ঈ-বর্ণ নেই বলায় কবিরা ক্ষুব্ধ হয়ে বলবেন, আপনি কবিতার কিছু বোঝেন না৤ সবিনয়ে বলি, সে কথা ঠিকই, আমি গানও কিছুমাত্র বুঝি না, আবৃত্তিও তাই৤ সাধারণ লেখায় যেমন আমরা গানের সুরলিপি বা স্বরলিপি করে লিখি না, তেমনি আবৃত্তির জন্য ব্যবহৃত কৌশলও সাধারণ লেখায় ব্যবহার করা হয় না৤ গান বা কবিতা লেখা হয় সাধারণ লিপিতে, তারপরে তা গাওয়ার সময়ে, বা আবৃত্তি করার সময়ে তাতে বিশেষ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়, অর্থাৎ সুর সংযোগ করা হয় বলেই সেটা গান হয়৤ আবৃত্তির ক্ষেত্রেও তাই৤ বিশেষ ভঙ্গী বা প্রক্রিয়া প্রয়োগ করলে তবেই তা আবৃত্তি হয়৤ হরফ দেখে সাদামাটা পড়ে গেলেই তা আবৃত্তি হয় না(সাদামাটা পড়লে সেটা ঠিক মতো পড়াও হয় না)৤ যেমন হয়না গানও! যদিও সুরলিপি বা স্বরলিপির মতো আবৃত্তি-লিপি বলে আলাদা কিছু নেই, তাই দীর্ঘ ঈ-বর্ণ নিয়ে তর্ক ওঠে, আবৃত্তি-লিপি বাস্তবে না-থাকা আবৃত্তিকার বা কবিদের ত্রুটি বা ন্যূনতা (deficiency)৤ সুরলিপি বা স্বরলিপির মতো কবিরা আবৃত্তি-লিপি তৈরি করে নিন, তাহলে আর তর্ক উঠবে না৤ নৃত্যলিপি করার প্রয়াস দেখেছি৤ কবিরা, আবৃত্তিকারেরা তাদের দায় কেন সাধারণ মানুষের উপরে চাপিয়ে দেবেন? এরপর তো তাহলে গায়কেরাও বলবেন যে সাধারণ লেখায় সুরলিপি বা স্বরলিপি ব্যবহার করতে হবে! সাধারণ যে কবিতা শুনি তা যখন গানের মাধ্যমে উপস্থিত করা হয় তখন তাতে সুর দিয়ে এমন করা হয় যে, তা গদ্য পাঠের সঙ্গে মেলে না৤ জীবনান্দের কবিতা, তার গীত রূপ এক নয়৤ তার জন্য গদ্যপাঠে সুর যোগ করার ব্যবস্থার দরকার নেই৤


        সাধারণ লেখায় তাই-- দীর্ঘ ঈ আমরা ব্যবহার করব না৤ এরকম অনেক ধ্বনি বাংলায় আছে যার লিপি সাধারণ লেখায় আমরা ব্যবহার করিনা৤ আমরা ব্যবহার করিনা কারণ তার মূর্ত লিপি বাংলায় নেই-ই৤ আবারও উল্লেখ করা যাক, “এক একটি ধ্বনিবর্গের প্রকাশ এক একটি বর্ণের মাধ্যমে৤... প্রত্যেক ধ্বনির জন্য বর্ণ বরাদ্দ করা কখনোই সম্ভব নয়, কোনো ভাষাতেই তা করা হয় না৤ ...ধ্বনি অগুনতি, বর্ণ গোনাগুনতি৤” 

        বাংলায় স্বরবর্ণের লিপি ১১টি মাত্র, কিন্তু এর বর্ণ(উচ্চারিত রূপ) কম করে আছে আরও ৩৩টি৤ তাদের লিপি বাংলায় নেই, তাই তা দেখানো সম্ভবও নয়৤ নানা কৌশলে সে কাজটা আমরা সারি৤ 

        কৌশল করে সারার এই স্বরধ্বনিগুলিকে আমরা বলি সন্ধিস্বর৤ একাধিক স্বরধ্বনি একত্রে মিলিত হয়ে তৈরি হয় এই সন্ধিস্বর৤ বাংলায় প্রচলিত স্বরবর্ণগুলির দুটি তথা-- ঐ, ঔ হল সন্ধিস্বর৤ ঐ=ওই, ঔ=ওউ৤ এমনি সন্ধিস্বর বাংলায় আছে মোট ৩৫টির মতো৤ এগুলি হল-- দ্বিস্বর, ত্রিস্বর, ... ইত্যাদি(Diphthong, Triphthong, Tetraphthong, Pentaphthong)৤ 

        অর্থাৎ দুটি স্বর মিলে, তিনটি স্বর মিলে, চারটি স্বর মিলে, পাঁচটি স্বর মিলে গঠিত সন্ধিস্বর৤ কিন্তু লিপি প্রচলিত আছে এমন সন্ধিস্বর বাংলায় আছে ২টি, এবং লিপি প্রচলিত না-থাকা সন্ধিস্বর আছে ৩৩টি, এই মোট(২+৩৩=)৩৫টি৤ যেগুলির লিপি প্রচলিত নেই সেগুলিরও কিন্তু উচ্চারণ আছে, তা না হলে সেগুলি যে আছে, একথা বলা যেত না৤ দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, (তিনটি স্বর মিলে সন্ধিস্বর) এইও=হেঁইও; (চারটি স্বর মিলে সন্ধিস্বর) আওআঅ=খাওয়ায়; (পাঁচটি স্বর মিলে সন্ধিস্বর) আওআইআ=খাওয়াইয়া৤ যেখানে দুটি স্বরধ্বনি মিলে সন্ধিস্বর হয়েছে, সেখানে তার লিপি গঠন করা গেছে, বা সহজে গঠন করা গেছে, কারণ তাদের সংখ্যাও অল্প-- মাত্র দুটি(ঐ ঔ)৤ কিন্তু অনেক স্বরধ্বনি মিলে সন্ধিস্বর যেখানে হয়েছে সেখানে লিপি গঠন করা যায় নি, কারণ তাদের সংখ্যাও যে অনেক(৩৩টি)৤



১৯

          ৫টি স্বর মিলে সন্ধিস্বর-- ‘আওআইআ’৤ এর একটা নতুন লিপি তৈরি করা যাক-- , ৪টি স্বর মিলে সন্ধিস্বর ‘আওআঅ’ হোক-- ৤ অন্যগুলোরও এমনিসব লিপি বানালে কেমন হয়৻ দুটি মাত্র স্বরধ্বনি নিয়ে গঠিত সন্ধিস্বরের হরফরূপ(ঐ, ঔ) অনাবশ্যকভাবে বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেছে৤ বাংলা বর্ণমালার সরলতা সম্পাদনে তাই এদুটি সন্ধিস্বরের লিপিরূপ বর্জন করা হবে৤ বিদ্যাসাগর মহাশয় যেমন বাংলা বর্ণমালা থেকে দীর্ঘ-ঋ(ৠ), দীর্ঘ-ঌ(ৡ) বর্জন করেছিলেন৤ বাংলা স্বরবর্ণের বিশেষ অনুধাবন করে তাই বাংলা স্বরবর্ণে মাত্র সাতটি(৭টি) বর্ণলিপি রাখা হবে৤ বাকিগুলি বর্ণের সাধারণ লেখায় দরকার নেই৤ সেগুলি বাংলা বর্ণমালায় বাহুল্যমাত্র৤ সেগুলি বাংলা বর্ণের গহনা নয়, তা নিতান্ত বাহুল্য৤ 

        ইংরেজিতে আছে ৫টি স্বরবর্ণ তথা vowel, কিন্তু আসলে ইংরেজিতে স্বরবর্ণ আছে আরও বেশি, মোট প্রায় ২০টি৤ বাংলায় মোট স্বরবর্ণ দাঁড়াচ্ছে ৪২টি(মূল ৭+সন্ধিস্বর ৩৫ =৪২টি)৤ 

        এই যে বাংলা নতুন বর্ণমালায় সাতটি স্বরবর্ণ, তার সজ্জাও হবে নতুন করে৤ নতুন স্বরবর্ণমালার সজ্জাক্রম হবে--  উ ও অ আ এা এ ই৤ 
        অর্থাৎ বর্তমানে যে-সজ্জাক্রমে পড়া হয়-- অ আ ই উ এ (এা) ও, সেভাবে আর পড়া হবে না৤ কেন বর্তমান ক্রম পালটে নতুন ক্রমে স্বরবর্ণ পড়া হবে? নতুন করতে হবে বলে কি সব কিছু পালটে দিতে হবে? 

          নতুন-ক্রমে বাংলা স্বরবর্ণ যে পড়া হবে তার কারণ হল-- বাংলা স্বরবর্ণের উচ্চারণ-স্থান অনুসরণ করে এই নতুন-সজ্জাক্রম গঠন করা হবে৤  

        যে-স্বরবর্ণ মুখের যে-স্থান থেকে উচ্চারণ করা হয় বর্ণমালায় তাদের অবস্থান হবে ঠিক তেমনি পরপর৤ লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, উ-ধ্বনি উচ্চারণ করা সবচেয়ে সহজ, এবং এটির উচ্চারণ হয় মুখের ভিতরে জিভের পিছন দিক থেকে৤ আর এদের পরপর অবস্থান হল-- উ ও অ আ এা এ ই৤ 

        লক্ষ করলে দেখা যাবে জিভ পিছনের উচ্চস্থান থেকে ক্রমে নিচে নামছে, এবং একই সঙ্গে সামনের দিকে এগোচ্ছে, এবং ক্রমে সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছে, আবার জিভ উঁচুতে উঠতে থাকে, একই সঙ্গে সামনের দিকে এগোতেই থাকে, এবং জিভের অগ্রভাগ নিচে দাঁতে চাপ দেয়৤ অর্থাৎ সামনে এগোতে এগোতে, উঁচু থেকে নিচে নেমে আবার উঁচুতে ওঠে-- আর এভাবে উচ্চারণ-স্থান এক অর্ধবৃত্তাকার পথ পরিক্রম করে৤ 


বাংলা স্বরবর্ণের উচ্চারণ কালে জিভ একটি প্রায় অর্ধবৃত্তাকার পথ পরিক্রম করে৤
 
        
        মুখ বন্ধ রেখেও উ-ধ্বনি উচ্চারণ করা যায়৤ উ, উঁ, উম্‌ --এসব ধ্বনি কি খুব সহজে মুখ বন্ধ করেও প্রায় বিনা-আয়াসে উচ্চারণ করা যায় না? তাই এটি, অর্থাৎ -- উ, হবে প্রথম স্বরধ্বনি৤ ‘উ’ হল-- উচ্চ, পশ্চাৎ, সংবৃত, বর্তুল(প্রলম্বিত) স্বরধ্বনি৤ 

        লক্ষ করার বিষয়, এটি কণ্ঠ্য স্বরধ্বনি, তাই এটি প্রথম বা শুরুর স্বরধ্বনি,  এবং ‘ই’ হল শেষ বা সপ্তম (তালব্য)স্বরধ্বনি৤ স্বরধ্বনির সজ্জা শুরু হবে কণ্ঠ থেকে, এবং শেষ হবে ওষ্ঠে এসে৤ একটি 
চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে স্বরধ্বনিগুলির অবস্থান ও উচ্চারণ-স্থান নির্দেশ করা যায়৤



 ২০

        বর্ণমালায় নতুন ক্রম অনুসরণ করলে সবচেয়ে কম পরিশ্রমে বা কম আয়াসে বাংলা স্বরধ্বনিগুলি উচ্চারণ করা যাবে৤ বাংলা স্বরবর্ণের প্রচলিত বর্তমান ক্রমমোটেই একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ক্রম নয়৤ তাই তা পালটে নতুন ক্রম অনুসরণ করা হবে৤ নতুন ক্রমের সুবিধা এই যে, তা মনে রাখা সহজ হবে, এবং মনে রাখার জন্য বিশেষ বেগ পেতে হবে না, কারণ মুখস্থ না করে প্রায় কেবল স্থানের ক্রম অনুসরণ করলেই তা অনায়াসে পরপর মনে পড়বে৤ 

        একটু অ-প্রাসঙ্গিকভাবেই বলে রাখি-- বানান না-জানা থাকাটা নির্দেশ করে যে, নির্দিষ্ট শব্দের নির্দিষ্ট হরফ সংযোজন জানতে হবে, এবং মনে রাখতে হবে৤ বানান স্বাভাবিক এবং স্বতঃপ্রণোদিত হতে পারবে না৤ তাই সে-দিন এক রাজনৈতিক দলের মিছিলের পোস্টারে দেখা গেল ‘লজ্জা’ বানানের বদলে লেখা হয়েছে “লজ্বা”৤


         এটাকে সাংবাদিক বানানের লজ্জা বলেই বর্ণনা করেছেন, তবুও প্রশ্ন এই-- বানান কি মুখস্ত করার জিনিস বলে বিবেচ্য হবে? বানান কি  অনায়াস হতে পারবে না? বানানের গোলোকধাঁধা স্বাভাবিক লজ্জা বানানকেও অস্বাভাবিক ‘লজ্বা’ বানানে পরিণত করেছে৤ বানান ব্যাপারটা হাওয়া-বাতাসহীন এক দমবন্ধ খাবিখাওয়া অস্থির অবস্থা নির্দেশ করে-- ‘লজ্বা’ বানান তারই নিদর্শন৤ তাই একদম লটারি করে বানান লেখা হচ্ছে ”লজ্বা’৤ এটা কি আসলে বানান-পতিদেরই লজ্জা নয়? 

        মানুষের শক্তি, সাধ্য এবং দক্ষতার(efficiency) ক্ষয় ঘটাচ্ছে বিকট বানান-ব্যবস্থা৤ মানুষের বক্তব্যটা যেন আসল নয়, বানানটাই আসল! (কেউ যদি বিচার চাইতে এসে ‘লজ্বাজনক’ ঘটনার উল্লেখ করে বিচার চায়, তখন কি তাকে বলা হবে আগে বানান ঠিক করে এসো!)৤

        বানান-চিন্তায় আমাদের শক্তিক্ষয় হচ্ছে, মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে বলে মানুষের বক্তব্যের মূল শক্তি কমে যাচ্ছে৤ বানানকে ‘অকারণ জটিলতার’ বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিলে মানুষের বক্তব্যের আসল শক্তি সহজে প্রকাশিত হবে৤ আমরা জোরালো আসলটা চাই, বানানে জটিলতার বেড়াজাল যেন চিন্তাশক্তির অনেকটা ছেঁকে টেনে নিয়ে শক্তিক্ষয় না ঘটায়৤ বানানটা কী লিখব সেই চিন্তা যদি প্রধান হয় তবে গভীর গুরুতর বিষয় লেখার সময়ে চিন্তার অনেকটা মনোযোগ টেনে নেয় বানান৤ তখন বিষয়ের গুরুত্ব কমে গিয়ে লেখকের মন চলে যায় বানানে৤ দ্রুত লিখতে, বা প্রাসঙ্গিক থাকতে এসব বেশ ব্যাঘাত ঘটায়৤ অর্থনীতিবিদ ‘রুগ্‌ণ’ শিশুর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যদি ‘রুগ্‌ণ’ বানান “রুগ্ন” লেখেন, কিংবা ‘সহযোগী’ আর ‘সহযোগিতা’ কিংবা ‘ধরন’ আর ‘ধারণ’ নিয়ে সংকটে পড়েন এবং সংকটে পড়ে অভিধান দেখতে যান, তবে তাঁর লেখা ব্যাহত হয়, খেই হারিয়ে চিন্তার মোড় ঘুরে যায়৤ তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন তা সেভাবে, জোরালোভাবে লেখা হয়ে ওঠে না৤ 

          অথচ অভিধান না দেখেও পারেন না, তাঁর মতো একজন পণ্ডিতব্যক্তির বানানে এমন ভুল তাঁর মর্যাদা কমিয়ে দেবে যে৤ বানান-বাণে তাঁর চিন্তা জখম হওয়ায় বাকিটুকু সহজে সেরে দেন৤ তাঁর বক্তব্যে গভীরতা কমে গিয়ে মানবহিত কমে যায়৤ কোথায় বানান আর কোথায় মানবহিত, সম্পর্কহীন দুই মেরুর জিনিস একে অন্যের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে! অথচ তা বোঝার কোনও উপায়ও নেই৤ অর্থনীতিবিদ যদি ভাবেন, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’, তবে তার দায় কার উপরে বর্তাবে? বানান বানান করে হনন করা হচ্ছে চিন্তার গভীরতাকে, ব্যাহত করা হচ্ছে লেখার মনোযোগকে৤ এ খামতি কী করে পোষানো হবে?




২১



চিত্র 




         এা      
ইঅ > ইও


বাংলা স্বরধ্বনি
           
জিভ-গতি
সম্মুখ
কেন্দ্রীয়
পশ্চাৎ
ঠোঁট-ভঙ্গী
       উচ্চ
 

    
     সংবৃত
   মধ্যোচ্চ
   এ

 
অর্ধ-সংবৃত
 মধ্য-নিম্ন
এা
অর্ধ-বিবৃত
      নিম্ন


      বিবৃত

প্রসৃত
বিবৃত
বর্তুল(প্রলম্বিত)


বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনি




২২




(উপরের চিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে আর করা হল না৤
সেটাই এক অতি দীর্ঘ নিবন্ধ হয়ে যাবে)


        বাংলা নতুন স্বরবর্ণমালা অনুসরণ করে লিখলে তা কেমন হবে তা একটু দেখা যাক৤ ইংরেজিতে একটি বাক্য আছে যার মধ্যে সকল ইংরেজি হরফ ধরা আছে(THE QUICK  BROWN  FOX  JUMPS  OVER  THE  LAZY  DOG)৤ একে বলে  প্যানগ্রাম[Pangram="every letter"])৤ বাংলায় তেমন বাক্য নেই৤ বাংলায় অনেক বেশি হরফ এবং চিহ্ন থাকায় বাংলা সকল হরফ নিয়ে তেমন কোনও বাক্য তৈরি হয়নি৤ কাজ চলাবার মতো একটি এমনি বাক্য তৈরি করা হল৤ 

        নিচের বাক্যটিতে বাংলা সকল স্বরবর্ণ(১১), সকল ব্যঞ্জনবর্ণ(৪০), সকল স্বর চিহ্ন(১০), সকল ব্যঞ্জনচিহ্ন তথা ফলা(৮টি) দেখানো আছে৤ অর্থাৎ মোট ১১+৪০+১০+৮=৬৯টি রূপ তথা হরফ, চিহ্ন, ফলা গঠন আছে৤ 
 
সর্বান্তিক সংযোজনসহ বাক্যটি এখানে দেখানো হল৤ 

বিষণ্ণ ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদি বাংলাভাষায় প্রচলিত ঈশপের   
নিখুঁত গল্পটির ডালপালা অর্ধেক ছড়াতেই ঋতু ভুঁইঞা 
আর ঐন্দ্রিলা ধড়ফড়িয়ে দারুণ হৈ-হৈ করে উঠল--   
ওঃ, ব্যাস্ এবার থামো তো, বুঝেছি বড্ডো পুরানো 
ঢঙের কেমন এক গল্প যার নীতিবাক্য হল, 
“মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বিঘ্ন 
ও বৃহৎ ক্ষতি”-- তাই না, এ্যাঁ? 


০১২৩৪৫৬৭৮৯   ৳৫৬/-     ৉৫৬/-  





২৩

        এই বাক্যটিতে বর্জন করে লিখলে দাঁড়াবে--

        বিষণ্ণ ঔদাসিন্যে ঊষাবৌদি বাংলাভাষায় প্রচলিত শপের নিখুঁত গল্পটির ডালপালা অর্ধেক ছড়াতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রিলা ধড়ফড়িয়ে দারুণ হৈ-হৈ করে উঠল__ ওঃ, ব্যাস্ এবার থামো তো, বুঝেছি বড্ডো পুরানো ঢঙের কেমন এক গল্প যার নিতিবাক্য হল, “মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জিবনে বিঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতি”-- তাই না, এ্যাঁ?


        এই বাক্যটিতে বর্জন করে এবং ই-কার=ী লিখলে দাঁড়াবে--
        বীষণ্ণ ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদী বাংলাভাষায় প্রচলীশপের নীখুঁত গল্পটীর ডালপালা অর্ধেক ছড়াতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রীলা ধড়ফড়ীয়ে দারুণ হৈ-হৈ করে উঠল__ ওঃ, ব্যাস্ এবার থামো তো, বুঝেছী বড্ডো পুরানো ঢঙের কেমন এক গল্প যার নীতীবাক্য হল, “মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বীঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতী”-- তাই না, এ্যাঁ?
[এখানে আর ই/ঈ, ি/ী সংকট নেই, সর্বত্র , সর্বত্র ]



        এই বাক্যটিকে নতুন স্বরবর্ণমালা ব্যবহার করে লিখলে হবে--

        বীষণ্ণ ওউদাসীন্যে ষাবউদী বাংলাভাষায় প্রচলীশপের নীখুঁত গল্পটীর ডালপালা অর্ধেক ছড়াতেই ()তু ভুঁইঞা আর ওইন্দ্রীলা ধড়ফড়ীয়ে দারুণ হ-হ করে উঠল__ ওঃ, ব্যাস্ এবার থামো তো, বুঝেছী বড্ডো পুরানো ঢঙের ক্যামন এাক গল্প যার নীতীবাক্য হল, “মুঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বীঘ্ন ও (বৃ)হৎ ক্ষতী”-- তাই না, এ্যাঁ?


        এখনে ঋ, এবং ঋ-কার(ঋতু, বৃহৎ)-এর কোনও পরিবর্তন দেখানো হয়নি৤ কারণ এর পরিবর্তন কেমন হবে তা ব্যাখ্যা না করে, দেখানো যাবে না৤ এর থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, সকল পরিবর্তন একবারে করার চেষ্টায় অসুবিধা দেখা দিতে পারে, তার রীতি পদ্ধতি সব একবারে মনে রাখারও তো দরকার আছে৤ তাই স্বরবর্ণের ব্যবহার সম্পর্কিত সকল বিষয় আগে ব্যাখ্যা করে এগোনো যাক৤ 

        এখানে আবার মনে করিয়ে দিই যে, ২৫ বছরের প্রকল্প এটি, কাল থেকেই চালু হবে না৤ ধীরে ধীরে ধরে ধরে একটু একটু করে জীবনের তাল ও লয়ের সঙ্গে মিলিয়ে পরিবর্তন করা হবে৤ বর্ণের তুলনাংক অনুসারে যে বর্ণের ব্যবহার বেশি, এবং যেগুলি নিয়ে বিতর্ক কম, যেগুলি বেশি অচল হয়ে পড়েছে-- সেগুলি আগে আগে, একে একে পালটানো হবে৤ 

        ই/ঈ, উ/ঊ ধ্বনিগুলির মধ্যে-- এদের একটির ধ্বনি (তথা ই, উ) আছে, অন্যটির কেবলমাত্র লিপিরূপই  আছে, ধ্বনি নেই, তাই অপ্রয়োজনীয় লিপিরূপ ঈ, ঊ বাতিল হবে৤ 


        এ-কার=ে= ৙ অর্থাৎ প্রচলিত এ-কার চিহ্ন উলটে লিখতে হবে৤ স্বরবর্ণের ‘এ’ হরফটির নিচের অংশটুকু বাদ দিলে এমনি আকৃতিই হবে৤ 


(দ্রষ্টব্য-- ভাষা, মে-অক্টোবর, ১৯৮৩, পৃঃ ৪৯-৫৪, বাংলাভাষায় বক্র-আ৤ আমারই লেখা নিবন্ধ৤
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত ভাষা বিষয়ক পত্রিকা “ভাষা”৤ সম্পাদক, মৃণাল নাথ, বর্তমানে অধ্যাপক)



        তাই লেখা হবে, আদেশ=আদ৙শ, ছেলে=ছ৙ল৙, মেয়ে=ম৙য়৙, আগে=আগ৙, পরে=পর৙






২৪

        লিপি নির্মাণ
        বাংলায় ক্যাট, ব্যাট বলার যে বক্র আ-ধ্বনি, বা এ্যা-ধ্বনি, গত দেড়শ বছর ধরে তার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু লিপি নেই৤ যদিও এর প্রস্তাবিত লিপি এবং প্রস্তাবিত স্বরচিহ্ন (বা ‘কার’-চিহ্ন) সব মিলিয়ে মোট প্রায় ১৭টি রূপ পাওয়া যায়৤ এটির একটি সুষ্ঠু লিপিরূপ ও স্বরচিহ্ন থাকা দরকার৤ পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয়ের দেওয়া লিপিরূপটিই সবচেয়ে ভালো, তাই এটি লেখা হবে-- এা
[“কেহ কেহ অ্যা, এ্যা, য়্যা লিখিতেছেন৤ স্বরবর্ণে য-ফলা কিম্বা অন্য ব্যঞ্জন যোগ অসম্ভব৤ য়্যা-র ধ্বনি ‘ইআ’-ই রহিল; ‘বাঁকা-এ’ হইল না৤ ‘এা’, এই যুক্তস্বর দ্বারা বাঁকা-একারের ধ্বনি প্রায় আসে৤ স্বরবর্ণের সহিত স্বরবর্ণ যুক্ত হইতে পারে৤ স্বরবর্ণের সহিত স্বরবর্ণের সন্ধি হইয়া অন্য স্বরের উৎপত্তি হইয়াছে৤ অতএব নূতন নয়৤ আমার বাঙ্গালা ব্যাকরণে এা উপস্থিত করিয়াছিলাম৤”--নবলিপি, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, “কি লিখি”,পৃঃ ১৮৮,
ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি,১৩৬৩[১৯৫৬], প্রবাসী,আষাঢ়, ১৩৫৫, জুন/জুলাই, ১৯৪৮]৤ 

        অর্থাৎ-- এাক(১), এাকটা, এাগারো(১১), এাকা, এাখন, এামন, এাদ্দিন ইত্যাদি৤ 
       এা=৙঄ (অর্থাৎ প্রচলিত এ্যা=‍্যা → ৙঄), নতুন প্রস্তাবিত বর্ণটি ‘এ’-তে আ-কার জুড়ে তৈরি 







 খেলা=খ৙঄লা, ব্যয়=ব৙঄য়, ত্যাগ=ত৙঄গ, ব্যাপক=ব৙঄পক]৤
(দ্রষ্টব্য-- উপরে উল্লিখিত ‘ভাষা’, মে-অক্টোবর, ১৯৮৩, পৃঃ ৪৯-৫৪, বাংলাভাষায় বক্র-আ৤)

        হাতের লেখায় একটানে লেখা যাবে--
অর্থাৎ “এ”-বর্ণটির তলার বাহুটি প্রলম্বিত করে মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নামিয়ে আনতে হবে৤ 




        Cat, Bat-এর যে এ্যা(Æ æ) ধ্বনি, তা লেখার জন্য বাংলায় প্রস্তাবিত
মোট ৮টি স্বরবর্ণ  তথা হরফ-- 
 
এবং ৯টি স্বরচিহ্নের প্রস্তাব -- 



অর্থাৎ ‘এা’ স্বরধ্বনির বর্ণলিপি এবং স্বরচিহ্ন মিলে মোট ৮+৯=১৭টি প্রস্তাব নানা সময়ে দেখা গেছে৤
       


             মাত্রা সহযোগে এ-কার [ ] ব্যবহার করে রবীন্দ্রনাথ এই ধ্বনিটি বোঝাবার ব্যবস্থা করেছিলেন৤ কিন্তু শব্দের শুরুতে, মধ্যে এবং শেষে এ-কার হলে সর্বত্র তা করা যাবে না৤ যেমন-- অবেলা, কালবেলা, যাবে৤ 


         এা-বর্ণের স্বরচিহ্ন হবে-- এ-কার চিহ্ন(ে) উলটে দিয়ে(=৙ ) তার সঙ্গে আ-কার(া) জুড়ে৤ এখন যেমন য-ফলা আ-কার দিয়ে-- ‘ব্যাগ, ব্যাট’ লেখা হয়, এা-এর স্বরচিহ্নের রূপ অনেকটা তেমনই দেখতে হবে(ব৙঄গ, ব৙঄ট)৤  




২৫

        কেন এমন হবে? তার কারণ, ব্যবহারিক সুবিধার জন্য সকল স্বরচিহ্ন হরফের পরে বা হরফের ডাইনে লেখা হবে(আরও কারণের আলোচনা পরের ‘লিখন পদ্ধতি’ অনুচ্ছেদে
করা হয়েছে)৤ 
তাই-- দেশ=দ৙শ, বেশ=ব৙শ, রেশ=র৙শ, লেশ=ল৙শ৤
        এবং দেখা(দ্যাখা)=দ৙঄খা, খেলা(খ্যালা)=খ৙঄লা, ব্যাট=ব৙঄ট, ব্যাস্‌=ব৙঄স্‌৤   


       ও-কার=, প্রচলিত ও-কার(ো) বাতিল করে, বর্জিত ঔ-কার(ৌ) চিহ্নের কেবল শেষ অংশটি নিয়ে নতুন ও-কার(  ৚   ) তৈরি হয়েছে৤ (কোল=ক৚ল, গোল=গ৚ল, ঠোকা=ঠ৚কা, টোল=ট৚ল)৤



বাংলায় তাই মোট মৌলিক স্বরবর্ণ দাঁড়াল--৭টি৤ প্রচলিত ৬টি এবং নতুন ১টি, এই মোট ৭টি৤

স্বরবর্ণ(৭টি)
 অ
 আ
 ই
 উ
 এ
 এা
 ও
স্বরবর্ণ চিহ্ন
 ৹
  া
  ী
  ু
 ৙
 ৙঄
 
স্বরবর্ণ চিহ্ন প্রয়োগ
 
 কা
 কী
 কু
 ক৙
 ক৙঄
 ক৚
প্রচলিত
 ক
 কা
 কি
 কু
 কে
 ক্যা
 কো

প্রচলিত ব্যবস্থায় অ-বর্ণের কোনও বাহ্যিক স্বরচিহ্ন নেই৤ নতুন ব্যবস্থায় এটি নতুন প্রয়োগ৤ এটি হবে অ-কার = ৹

        ই-কার চিহ্ন(=ি) হরফের আগে বসে, এবং ঈ-কার চিহ্ন(=ী) হরফের পরে বসে, যেমন-- কি, কী৤ এভাবে ঈ-কার(ী) অপেক্ষা ই-কার(ি) হাতে করে লেখায়, টাইপ করায় ব্যবহারিক সুবিধা কম, তাই ই=ী চিহ্ন গ্রহণ করা হবে৤ ঈ-হরফ বর্জিত হওয়ায় ী-চিহ্নটিও অপ্রযোজ্য, এই কারণে ‘ ি ’ স্থানে সুবিধাজনক চিহ্ন “ ী ” গৃহীত হব৤ আর তাই লেখা হবে-- কী, দীদী, নীতী, বীবী, ভীতী, জমী, খুঁটী৤ 
        বাংলায় ঋ কোনও মৌলিক স্বরধ্বনি নয়, এবং বাংলা ভাষার জন্মের কাল থেকেই এটি ‘রি’ হিসেবে উচ্চারিত, তাই অসার্থক এবং অপ্রয়োজনীয় বর্ণ ঋ বাতিল৤ [ঌ(লি) বর্ণটি যেমন এযুগে অলক্ষ্যে আপনিই বাতিল হয়ে গেছে]৤ 


         “সংস্কৃতে /ঋ/(হ্রস্ব ও দীর্ঘ) /ও/ ঌ/ পশ্চাৎ স্বরধ্বনিরূপে উচ্চারিত হত৤ মধ্যভারতীয় আর্যস্তরেই এই ধ্বনিগুলি স্বররূপে লুপ্ত৤” (বাংলাভাষার আধুনিকতত্ত্ব ও ইতিকথা, প্রথমাংশ, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৫ পৃঃ-৯২)৤
        খেয়াল করতে হবে যে মধ্যভারতীয় আর্যস্তর হল বাংলাভাষা জন্মের আগের ব্যাপার৤
 



        লিখন পদ্ধতি--
        বাংলা লেখায় পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন করতে হবে৤ এখন স্বরচিহ্নগুলি হরফের ডাইনে, বাঁয়ে, নিচে, দু-পাশ ঘিরে বসে৤ ই-কার(ি) এবং ঈ-কার(ী) হরফের বাঁয়ে, ডাইনে তো বসেই, উপরেও ঢেকে রাখে৤ ব্যঞ্জনচিহ্নের মধ্যে রেফ( র্‍় ) হরফের উপরে বসে৤ উ-কার(ু), ঊ-কার(ূ) এবং ঋ-কার(ৃ) বসে হরফের নিচে৤ ও-কার(ো) বসে হরফের দুপাশ ঘিরে৤ হরফকে এভাবে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখার এই যে অ-যুক্তিশীল এবং ক্লিষ্ট লিখন-পদ্ধতি, তার পরিবর্তন করতে হবে৤ তাই ঋজু রীতি অনুসরণ করে সকল স্বরচিহ্ন কেবলমাত্র হরফের পরে, তথা ডাইনে লেখা হবে৤ এতে লেখার সুবিধা বাড়বে, কিবোর্ডের সাহায্যে কম্পোজ করার সুবিধা বাড়বে এবং লিখন পদ্ধতি-- নিবিড় যুক্তিভিত্তিক হবে৤ স্বরবর্ণ চিহ্নসমূহ যোজিত বর্ণের পরে যে বসবে তার অন্য প্রধান কারণ হল, পাঠের সময় স্বরের ধ্বনি সর্বদা যোজিত বর্ণের পরেই হয়৤ ক+া=কা, ক+ি=কি, ক+ী=কী৤ 

        লেখার সময়ে ই-কার(ি) হরফের আগে লিখলেও তার উচ্চারণ সব সময়ে ক-এর পরেই হয়৤ ‘ি ক’(হ্রস্ব ই-কার, ক) লেখার জন্য তা উচ্চারণে “ইক” হয়না৤ 



ই-কার = ি  হল ই-স্বরধ্বনির দ্বৈতীয়িক রূপ বা সেকেন্ডারী ফর্ম৤ দ্বৈতীয়িক রূপ কোনও বর্ণের সঙ্গে যোজিত হলে ‘ই’-এর নিজস্ব ধ্বনি পৃথক্‌ভাবে বা পূর্ণভাবে প্রকাশ করে না, বরং তা সাথী বর্ণের ধ্বনিকে হ্রস্ব করে, তাই ক+ই-কার=ক+ি= ি ক= কি=ক্‌৤ এটি তখন “ইক” নয়৤ এটি তখন ই-কার তথা ই-ধ্বনির দ্বৈতীয়িক রূপ৤ তা বোঝাতে এটিকে স্বরচিহ্নরূপে প্রকাশ করা হয়৤ তাই, ক্‌ই=ি ক =কি৤ স্বরচিহ্ন ডাইনে বাঁয়ে নিচে যেখানেই বসুক সকল স্বরচিহ্নের উচ্চারণই সাথী বর্ণের পরে হয়৤ তাই, ই-কার(ি) ক-এর আগে বসালেও ই-ধ্বনিটি উচ্চারিত হয় সাথী বর্ণের পরেই৤ চিহ্নগুলি বাসবার জন্য প্রাচীন দিনে হরফের চারিদিক বেছে নেওয়া হয়েছে, সেটার জন্য স্বরচিহ্নের উচ্চারণ কিন্তু কখনও আগে হবে না৤
        শব্দে দুটি বর্ণ পাশাপাশি বসলে প্রত্যেক বর্ণের আলাদা আলাদা উচ্চারণ হয়, এবং
শব্দটিতে বর্ণগুলির পরপর অবস্থান অনুযায়ীই তাদের পরপর উচ্চারণ হয়[ব ই=বই, এটি ‘বি’ নয়]৤




২৬



স্বরচিহ্নের অবস্থান


          স্বরবর্ণের ক্ষেত্রে যদি বর্ণটি না-বসিয়ে তার কার-চিহ্ন/স্বরচিহ্ন Secondary form দ্বৈতীয়িক রূপ[যেমন-- ি ী] বসানো হয়, তবে বর্ণলিপ্তি ঘটে৤ অর্থাৎ স্বরচিহ্নটির ধ্বনি, সঙ্গী ব্যঞ্জনবর্ণটির সঙ্গে মিলিতভাবে এক-লপ্তে, তথা এক প্রয়াসে উচ্চারিত হয়৤ তাই, ক+ি হয়-- ‘কি’(কিন্তু ক+ই= ‘কই’ হয়, অথবা ই+ক=ইক )৤ বর্ণলিপ্তি ঘটে বলেই ক+ি (ই-কার)=ক+ি → ি ক উচ্চারণ ইক  না হয়ে হয় “কি”৤ লেখার পদ্ধতির কারণে এখানকার ই-কার চিহ্নটি(ি) যোজিত হরফের আগে বসানো হয়৤ সকল হরফে ই-কার(ি) জুড়বার কালে তা সংশ্লিষ্ট হরফের আগে বসে, কিন্তু সব সময়েই ই-কার(ি) তথা ই-ধ্বনি যোজিত হরফের পরে হয়৤ তাই উচ্চারণ অনুসরণ করে সকল স্বরচিহ্ন যোজিত হরফের ‘পরে’ বসবে৤


        বর্ণের ধ্বনির ব্যাপারে আমরা কতটা সম্পর্কিত তা এই স্বরচিহ্ন ব্যবহার ও তার উচ্চারণ নিয়েই বোঝা যাবে৤ একাধিক বিকল্প স্বরবর্ণ থাকায় তাদের চিহ্নও ছিল বেশি৤ তাই চিহ্নগুলি হরফের চারিদিকে বসিয়ে লেখার ব্যাপারটা কোনও রকমে সামলে চালিয়ে নিতে হত, anyhow managed. এবার অকারণ-বর্ণগুলি বর্জিত হওয়ায়, তাদের সংখ্যা কমে যাওয়াতে হরফকে চারিদিক থেকে ঘিরে লেখার পুরানো দিনের ব্যবস্থা চালু রাখার আর মোটেই দরকার নেই৤


        একইভাবে ব্যঞ্জনচিহ্ন তথা ‘ফলা’-র ক্ষেত্রেও উচ্চারণ মেনে ফলাচিহ্ন হরফের “আগে” বসবে৤ দৃশ্যত রেফ( র্‍় ) চিহ্ন হরফের পরে বসে বলে মনে হলেও এটি হরফের আগেই বসে(বলার সময়ে আমরা যদিও বলি ক-এ রেফ, ব-এ রেফ ইত্যাদি), কারণ র-জাত রেফ-এর উচ্চারণ হয় যোজিত তথা সঙ্গী হরফের আগেই(পরে নয়)৤ কর্ম=ক৒ম, গর্ব=গ৒ব, বর্শা=ব৒শা, বর্গ=ব৒গ৤ এখানে র-এর উচ্চারণ হবে, সঙ্গী বা যোজিত বর্ণের পূর্বে সাথীবর্ণের সঙ্গে একলপ্তে৤ র-এর এখানে পৃথক উচ্চারণ হবে না৤ শব্দটি ‘কঅরঅম্’(ক৹র৹ম্ KARAM) উচ্চারণ হবে না, উচ্চারণ হবে ক্রম KRAM৤ স্বরধ্বনির সাহায্য না নিয়ে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করা কঠিন, বলা যায় দুরুচ্চার্য৤ বাংলায় ব্যঞ্জনধ্বনি সহজে উচ্চারণ করার সুবিধার্থে প্রতিটি বর্ণের সঙ্গে “অ” যুক্ত করে নেওয়া হয়৤ অর্থাৎ প্রতিটি বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে ‘অ’ হল সহজাত বা সহবর্তী (inherent)৤ তাই যখনই আমরা কার-চিহ্ন/স্বরচিহ্ন Secondary form (া, ি, ী, ু) দেখি তখন তার উচ্চারণ সাথী বর্ণের সঙ্গেই করি৤ কিন্তু পৃথক কোনও বর্ণ হলে উচ্চারণে পূর্ণ মূল্য দিই৤ যেমন--গরম৤ কিন্তু ‘ক৒ম’ শব্দে ‘৒’ ছোটো, তাই তার উচ্চারণও হবে ছোটো তথা লঘু৤ সুতরাং ‘ক৒ম’ শব্দটির উচ্চারণ হবে--ক৒ম= (কর্ম)ক৹র্‌ম৹ KARMA


      যোজ্য স্বর-চিহ্ন সহযোগী হরফের পরে, বসানো হবে যুক্তি মেনে--কারণ, স্বরচিহ্নের উচ্চারণ সহযোগী হরফের পরেই  হয়, কা=ক+আ-কার, কি=ক+ই-কার, কে=ক+এ-কার৤ 

এবং যোজ্য ব্যঞ্জন-চিহ্ন সহযোগী হরফের পরে বাসনো হবে৤ 
ফলা তথা ব্যঞ্জনচিহ্নের উচ্চারণ সহযোগী হরফের পরে  হয় কেবল রেফ-এর ক্ষেত্রে আগে  হয়৤  

স্বরচিহ্ন -- া  ি  ী ু ূ ৃ ে ৈ ো  উচ্চারণ সাথী বর্ণের পরে হয়
ব্যঞ্জনচিহ্ন বা ফলা -- ্য ্র   র্‍   ইত্যাদি উচ্চারণ সাথী বর্ণের আগে/পরে হয়৤






স্বরচিহ্ন    ি                  

           কা=ক্​আ      কি=ক্​ই      কী=ক্​ঈ
           কু=ক্​উ       কূ=ক্​ঊ       কৃ=ক্ঋ
           কে=ক্​এ      কৈ=ক্ঐ     কো=ক্​ও
           কৌ=ক্​ঔ






ণ, ন, ব, ম, য, র(রেফ, র-ফলা), ব =৭+১=৮


আগে→  কর্ম = ক র্‌ম      ধর্ম= ধ র্​ম =রেফ  র্‍় 



পরে →  উষ্ণ=উ ষ্​ণ     তীক্ষ্ণ= তী ক্ষ্​ণ= ণ ফলা
         মগ্ন=ম গ্​ন    বিঘ্ন=বি ঘ্​ন =ন ফলা
         জন্ম= জ ন্​ম   রুক্ম=রু ক্​ম =ম ফলা
         শল্য= শ ল্​য     বন্য= ব ন্​য = ‍্য য-ফলা
         ক্রম = ক্‌র ম    ভ্রম=ভ্​র ম =‍্র র-ফলা  
         ত্বক=ত্​ব ক    ক্বাথ=ক্​বা থ= ব-ফলা



যুক্তব্যঞ্জন হবার ক্ষেত্রে প্রথম বর্ণটি/বর্ণ দুটি আয়তনে ছোটো হবে, শেষেরটি আয়তনে যথাযথ বা স্বাভাবিক হবে --







              

জ্জ্ব - [উজ্জ্বল] =জ্​ জ্​ ব
স্প্ল - [স্প্লিট] = স্​ প্​ ল
ক্ত্র - [বক্ত্র]= ক্​ ত্​ র
ক্ল্য - [শৌক্ল্য]= ক্​ ল্​ য






২৭



যে স্বরবর্ণগুলি বাতিল হল, সেগুলির পরিবর্ত হবে নিচের পদ্ধতি মতো:-- 
পরিবর্ত
                               
স্বরবর্ণ
স্বরচিহ্ন
প্রয়োগ
ঈ=ই  
ী=ী
(ি চিহ্নটি বাতিল৤ ই-কার= ী, গ্রহণ করা হয়েছে)
ঈগল=ইগল, ঈশান=ইশান৤ আমি=আমী, নীতি=নীতী
ঊ=উ
ূ=ু
ঊন=উন, ঊরু=উরু, ঊষর=উশর৤
দূর=দুর, নূপুর=নুপুর, মুহূর্ত=মুহুর্ত
ঋ=৒রী
ৃ=রী
ঋণ=৒রীন, ঋষিকেশ=৒রীশীক৙শ, হৃষিকেশ=হ্‍রীশীক৙শ, ঘৃত=ঘ্‍রীত, গৃহ=গ্‍রীহ
ঐ=ওই
ৈ=[অ/ও]ই
   = ৚ই
ঐরাবত=ওইরাবৎ , ঐহিক=ওইহীক৤
খৈল=খইল/খ৚ইল, হৈ-হৈ/হই-হই=হ৚ই-হ৚ই
ঔ=ওউ

ৌ=[অ/ও]উ
    =৚
ঔদরিক=ওউদরীক, ঔষধ=ওউশধ৤
কৌশল=ক৚উশল, গৌরব=গ৚উরব


স্বরবর্ণ-চিহ্ন ব্যবহারের পদ্ধতি:-- 

        অ= এবং ‘কিছু নয়’ Nil, তথা উহ্য-- অর্থাৎ অ-চিহ্নটি হবে ডিগ্রি চিহ্নের(৹) মতো দেখতে,
যা বর্ণের পরে বসবে৤ যেসকল ক্ষেত্রে অ-ধ্বনি= বোঝাবার বিশেষ  প্রয়োজন আছে, কেবলমাত্র সেই সকল ক্ষেত্রেই অ-ধ্বনি চিহ্ন=৹ বসানো হবে৤ অন্যত্র তা, বর্তমানে প্রচলিত প্রথার মতো ‘কিছু নয়’ Nil, তথা উহ্য থাকবে৤ অহরহ=অহরহ, কত=কত, গুহ=গুহ, ঘন=ঘন, জড়=জড়, তব=তব, তর=তর, দ্বন্দ্ব=দন্দ, দ্ব্যর্থ=দ৒থ, নগ=নগ, ভজ=ভজ, মম=মম, যত=জত, লহ=লহ, ব্রণ=ব্‍রন৹, শশ=শশ, [এবং হিন্দি উচ্চারণের প্রভাব এড়াতে অমিতাভ=(বিকৃত উচ্চারণ অমিতাভ্‌ স্থানে) অমিতাভ]৤ কম্‌ল=কমিল, কমল্‌=পদ্মফুল, বাশ্‌ব=[ভালো]বাস্‌ব, বাশব=ইন্দ্র৤ 

        বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে সব সময়েই ‘অ’-ধ্বনি সংযোজিত থাকে, এতে বর্ণধ্বনিটি উচ্চারণ করায় সুবিধা হয়, যদিও বাহ্যিক চিহ্ন দেখানো হয় না৤ ক্+অ=ক, ল্+অ=ল৤ নইলে তা বর্ণসংযোগ বা বর্ণযুক্তি বোঝায়-- ক্+ল=ক্ল 



 (এটি আসলে ক্+ল্+অ=ক্+ল= ক্ল/ 
)৤ 

এবার থেকে প্রয়োজন হলে 
অ-চিহ্ন(নব গঠিত ) দেখানো হবে৤

        বাংলা স্বরবর্ণমালা পুরোটা সংস্কার করার পরে যা দাঁড়াবে এবারে তা দেখা যাক--
        স্বরবর্ণ(৭টি)-- অ          এা  ও 
        স্বরবর্ণ চিহ্ন--               ৙঄   ৚ 
       
        এই স্বরবর্ণমালা ব্যবহার করে বর্ণ-ধারক বাক্যটি(Pangram) লিখলে কী দাঁড়াবে দেখা যাক--

        বীষণ্ণ ওউদাসীন্য ষাব৚দী বাংলাভাষায় প্রচলীশপনীখুঁত গল্পটীর ডালপালা অর্ধক ছড়াত ৒রীতু ভুঁইঞা আর ওইন্দ্রীলা ধড়ফড়ী দারুণ -হ৚ ক৚ উঠল৚-- ওঃ, ৙঄স্ এবার থাম৚ ত৚, বুঝছীড্ড৚ পুরান৚ ঢঙ৙঄মন এাক গল্প যার নীতীবাক্য হ৚ল৚,“মুঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবন বীঘ্ন ও ব্‍রীহৎ ক্ষতী”-- তাই না, ৙঄

(নতুন রীতিতে ঋ=৒রী, বৃ=ব্‍রী,  

  = রু লেখা হবে)
  



 
২৮

        এখানে নতুন স্বরবর্ণ সবকটি ব্যবহার করে ধারক বাক্যটি লেখা হল বটে কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে গেল৤ সংস্কার-করা স্বরবর্ণের মতো সংস্কার-করা ব্যঞ্জনবর্ণ প্রয়োগ করার পরে প্রশ্নগুলো বেশ কিছুটা কমবে৤ তবু নতুন ব্যবস্থায় প্রবেশের মুখে প্রশ্ন অনেকই থাকবে, থাকাই স্বাভাবিক-- যা ধীরে ধীরে আলোচনার মাধ্যমে মিটবে৤

        এবারে লিপি সংস্কারের কথা কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া যাক, তারপরে ব্যঞ্জনবর্ণ সংস্কারের কথায় আসা যাবে৤ 

        ইংরেজিতে Small letter, এবং CAPITAL LETTER আছে, বাংলায় তেমন কিছু নেই৤ অর্থাৎ বাংলায় CAPITAL LETTER বলে কিছু নেই, বাংলায় সব একই রকম হরফ৤ ইংরেজির চেয়ে বাংলায় হরফ অনেক বেশি৤ এছাড়া, বাংলায় আছে প্রায় ৩৯৫টি যুক্তবর্ণ৤ বাংলায় হরফ বেশি থাকায় সুবিধা যেমন কিছু আছে, তেমনি কিছু বাড়তি অসুবিধাও আছে৤ টাকা  এবং তাকা  বাংলায় লেখাও যাবে এবং বোঝাও যাবে, ইংরেজিতে সেটা হবার জো নেই৤ আবার বর্ণ-ধারক বাক্য ইংরেজিতে লেখা যত সহজ, বাংলায় তা লেখা তেমনি কঠিন৤ পরিচ্ছন্ন করে নাম ঠিকানা লিখতে যখন বলা হয়, তখন বলা হয়  CAPITAL LETTER-এ লিখতে৤ বাংলায় তেমন বলার দরকারও নেই, সুযোগও নেই৤ আবার ইংরেজিতে হরফের আলংকারিক রূপ আছে প্রায় হাজারের উপর, বাংলায় নেই একটিও! বাংলার সেই বিশাল যুক্তবর্ণ বাহিনীই তার না-থাকার কারণ৤ অবশ্য বাংলায় মূল বর্ণ বা হরফও অনেক বেশি৤ 

        ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কালে ড্রইং করার সূচনায় LETTER ড্রইং করতে হয়৤ আর সেই LETTER হল, ইংরেজি CAPITAL LETTER, এবং অপ্রধানভাবে Small letter, যা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং করার যন্ত্রপাতি তথা-- সেট-স্কোয়ার, টি, কাঁটা-কম্পাস, পেনসিল-কম্পাস, ডায়াগোনাল স্কেল ইত্যাদি ব্যবহার করে আঁকতে হয়৤ আর বাংলায় সেসব কোনও ব্যাপারই নেই৤ এজন্য বাংলায়ও LETTER DRAWING করার উদ্দেশ্যে বাংলা বর্ণগুলিকে বিশেষ জ্যামিতিক রূপ দেওয়া হয়েছে৤ সেগুলিকে বলা যেতে পারে-- বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা৤ 

        আঁকার যন্ত্রপাতির সাহায্যে বাংলা বর্ণের এই বিশেষ রূপগুলি আঁকা/লেখা যাবে৤ এই কাজ করতে গিয়ে বাংলা যুক্তবর্ণ লেখার সমস্যা, একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল৤ তাই এর একটি যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান খুঁজে বের করতে হয়েছে৤ 

        ইঞ্জিনিয়ারিং কায়দায় বাংলা ১১টি স্বরবর্ণ, ৪০টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ১০টি স্বরচিহ্ন বা কারচিহ্ন, ৮টি ফলা তথা ব্যঞ্জনচিহ্ন, অর্থাৎ মোট ৬৯টি হরফরূপ তৈরি করতে হবে৤ এছাড়া আছে ৩৯৫টি যুক্তবর্ণের রূপ দেওয়ার অতি কঠিন কাজ৤ সে হিসেবে বাংলায় ৬৯+৩৯৫= ৪৬৫টি বর্ণরূপ প্রয়োজন৤ এছাড়া, দরকার দশটি সংখ্যার রূপ, বিবিধ চিহ্ন ইত্যাদি৤ অথচ ইংরেজিতে দরকার মাত্র ২৬+২৬=৫২টি বর্ণরূপ(স্মল এবং ক্যাপিটাল লেটার মিলিয়ে)৤ আসলে ২৬টি CAPITAL LETTER হলেই কাজ চলে যায়৤ বাংলার এই দুর্ঘট ৪৬৫টি বর্ণরূপের সমস্যা মেটাবার জন্য তাই বাংলা যুক্তবর্ণ সমূহ যুক্তিভিত্তিক করে স্বচ্ছ করা হয়েছে৤ আসলে এটিই বাংলা বর্ণসমাবেশের প্রকৃত চিত্র৤ 

        যুক্তবর্ণ লেখার সময়ে আমরা দুটো বা তিনটে হরফ মিলিয়ে দলাপাকিয়ে মণ্ড করে যুক্তবর্ণ তৈরি করি৤ এটাই রীতি, কিন্তু এভাবে মণ্ডহরফ করে বাংলায় যুক্তবর্ণ না লিখে হরফগুলোকে পাশাপাশি লেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৤ এজন্য যুক্তবর্ণের প্রথম বর্ণ হবে আয়তনে ছোটো, এবং দ্বিতীয়টি, তথা পরের বর্ণটি হবে সাধারণ মাপের৤ এর ভাষাতাত্ত্বিক তথা ধ্বনিভিত্তিক কারণও আছে৤ সেটি একটু আগেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে৤ 



২৯

        বাংলায় যুক্তবর্ণ হয়-- দুই বর্ণ মিলে, তিন বর্ণ মিলে এবং চার বর্ণ মিলে৤ এর বেশি বর্ণের মিলনে বাংলায় যুক্তবর্ণ তৈরি হয় না৤ বাস্তবত বাংলায় চার বর্ণের যুক্তবর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তিন বর্ণেরই হেরফের৤ 


লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, ণ এবং ড মিলে দলা বা মণ্ড পাকিয়ে -- হয়৤ কিন্তু ং ঃ ঁ  এবং ্য  ‍্র   র্‍়   যুক্ত হলে ঠিক তেমন হয় না, এসব চিহ্নাদি-- হরফ, এবং মণ্ড বর্ণের পাশেই বসে৤ তাই বাস্তবত চার বর্ণের যুক্তবর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ব্যবহারিকভাবে তিন বর্ণের৤ 

        তাই, বাংলা যুক্তবর্ণ লিখবার দুটি সূত্র তৈরি করা হয়েছে--
        (১)  (২)


সূত্রের C হল consonant তথা ব্যঞ্জনবর্ণ৤ 
এখানে, C2 তথা দ্বিতীয় বা পরের বর্ণ হবে সাধারণ মাপের সাধারণ বর্ণ, এবং C1 তথা প্রথম বর্ণও হবে সাধারণ বর্ণই, তবে আয়তনে ছোটো৤ দুটি বর্ণই হবে অবিকৃত ও অক্ষত এবং অ-খণ্ডিত৤ যেমন-- ফর্দ=ফ৒দ, গর্ব=গ৒ব, কর্ম=ক৒ম, বর্শা=ব৒শা৤ এর আগেই এসব উদাহরণ দেখানো হয়েছে৤ 

এখানে যুক্তবর্ণের প্রথম বর্ণ বা C1 হল(অর্থাৎ ছোটো), এবং যুক্তবর্ণের দ্বিতীয় বর্ণ বা C2 হল যথাক্রমে-- দ ব ম শ৤ আরও যেমন--গল্প, গন্ধ, খদ্দর, সুন্দর, কম্পন৤    

        এই প্রক্রিয়ায় ভাষাতত্ত্ব এবং জ্যামিতিক গঠন তথা ইঞ্জিনিয়ারিং কৃৎ-কৌশল একীভূত হয়েছে৤ যা বাংলাভাষাকে এক জটিল আবর্ত থেকে মুক্তি দেবে৤ এই নতুন গঠনের হরফ ব্যবহার করে সাধারণ লেখা লিখতে পারা যাবে, এই হরফ ব্যবহার করলে মুদ্রণে স্থানসাশ্রয় ঘটবে প্রায় ৪০%শতাংশ৤ এতে বাংলা যুক্তবর্ণ হবে যুক্তিভিত্তিক, এবং তা সহজে লেখা এবং মনে রাখা যাবে৤ বাংলা-মাধ্যমে লেখাপড়ার সময়-সাশ্রয় ঘটবে প্রায় আড়াই(২.৫ তথা ২/ বছর)৤ 

        কেমন করে সেটা ঘটবে?
        ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে কিছু লিখলে তা বেশ যেন দুটি সমান্তরাল সরল রেখার মধ্যে থাকে(THE QUICK BROWN FOX JUMPS OVER THE LAZY DOG)৤ ছোটো হরফে লিখলে অবশ্য মনে হতে পারে যে তা বুঝি এই সমান্তরাল সরল রেখার মধ্যে নেই(The quick brown fox jumps over the lazy dog), কিন্তু আসলে তা দুটি সমান্তরাল সরল রেখার মধ্যেই থাকে, কারণ একটা নির্দিষ্ট এক্স-হাইটের(x-height, X --অক্ষরের উচ্চতা) মাপেই তা তৈরি৤ অক্ষর বা হরফগুলো সবই এক-তলা, যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে হরফ দ্বিগুণ, তিনগুণ তথা দোতলা, তিনতলা সমান উঁচুও হতে পারে, যেমন একতলা বাড়ি অনেক বেশি উঁচু হলে যা হয়৤ কিন্তু তা একতলা বাড়িই৤

ইংরেজি  fFgGjJkKlLiI, লেখায় খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, small letter-- gG এবং jJ হরফ দুটি সমান্তরাল সরল রেখার নিচে নেমে গেছে, অর্থাৎ আপাত দৃষ্টে small letter-এ মুদ্রণ-উচ্চতা বেশি লাগার কথা কিন্তু বাংলা লিখতে গেলে দেখা যাবে যে, সে লেখা প্রকৃতই তিনতলা৤
 যেমন-- অর্জুন, অর্বুদ, কর্তৃত্ব, খর্জুর, চিকির্ষু, মুহুর্মুহু, শার্দুল৤ 

ইংরেজিতে হরফের উচ্চতা এক সেমি. হলে, শব্দ বাক্য লেখার মুদ্রণ-উচ্চতা লাগে মোটে এক সেমি.৤ কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে লাগে-- ২সেমি.[০.৫( র্‍় রেফ)+১(মূল হরফ)+০.৫(ু উকার)], অর্থাৎ দ্বিগুণ৤ এর কারণ বাংলা লেখার, বিশেষ করে যুক্তবর্ণ লেখার পদ্ধতি এমন যে হরফের উপরে এবং নিচে নানা চিহ্ন ইত্যাদি জুড়তে হয়৤ যেমন ‘অর্বুদ’ লিখতে “র্বু” লেখার সময়ে ব-এর উপরে রেফ, এবং নিচে উ-কার 

দিতে হয়৤ ব-এর উচ্চতা যদি ১সেমি. হয় তবে রেফ-এর উচ্চতা হবে আধ(০.৫) সেমি., এবং উ-কার এর জন্য খাড়ই হবে আধ(০.৫) সেমি.৤ অর্থাৎ মোট মুদ্রণ-উচ্চতা লাগছে দুই(২) সেমি.৤ ইংরেজিতে এটা সব সময়েই হবে এক সেন্টিমিটারই মাত্র, এবং বাংলায় সব সময়েই দুই সেমি.৤ যেমন-- “নব” লিখতেও দুই সেমি. উচ্চতা লাগবে, কারণ এর পরের শব্দটি হয়তো হবে ‘অর্বুদ’, যার উচ্চতা ২সেমি.! সেজন্য স্থান সংকুলানের জায়গা রাখতে হবে৤




 ৩০


        বাংলা মুদ্রণে এই দ্বিগুণ উচ্চতা লাগার ফলে ছাপার জন্য জায়গা বেশি লাগে,(নয়তো ঘরের উচ্চতা কমাতে হয়, অর্থাৎ হরফ খর্ব করতে হয়, তাতে হরফ ছোটো হওয়ায় বই পড়া কঠিন হবে) তাই কাগজ দ্বিগুণ লাগে, খরচ অনেক বেশি হয়৤ দুর্ঘট এই অবস্থা কাটবে যদি তা বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালায় লেখা হয়৤ কারণ নতুন হরফে যুক্তবর্ণ বা স্বরবর্ণচিহ্ন লেখা হবে পাশাপাশি, কখনওই উপরে এবং নিচে নয় ৤ 

        প্রথমে একটি ছক কাটা কাগজ তথা graph paper নেওয়া হল৤ সেই কাগজে দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে নির্দিষ্ট ঘর নিয়ে হরফ আঁকা বা লেখা হল৤ এই মাপ এমন হতে হবে যে, সকল হরফ একই মাপের হবে৤ হরফের উচ্চতা সকল ক্ষেত্রে একই হবে, এবং দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি হরফের প্রস্থ একই হবে৤ অতিরিক্ত বাহু এই মাপের বাইরে হতে পারে৤ যেমন-- ক-এর সামনের আঁকড়ি, ই-এর পিছনের টান বা টিকি, ট-এর পিছনের টান ইত্যাদি এই মাপরে বাইরে হতে পারে৤ এর উদাহরণ দেখা যাক-- 


ছক কাটা কাগজ

GRAPH PAPER


 ব








 



 











        এখনও যেহেতু সকল ব্যাপার ব্যাখ্যা করা হয়নি তাই সব উদাহরণ এখুনি দেখানো যাবে না, মনেও ধরবে না৤ তবু দেখা যাবে যে, সকল হরফ যেন দুটি অদৃশ্য সমান্তরাল সরল রেখার মধ্যে আঁটানো হয়েছে৤  হরফের যা এক্স-হাইট(x-height) অর্থাৎ মূল খাড়াই তার মধ্যেই সব হরফকে আঁটানো হয়েছে, যেমন এখানে নতুন বর্ণমালা দেখানো হয়েছে-- 



অ আ ই উ এ এা ও
কখগঘঙচছজঝটঠডঢতথদধন
পফবভমরলশসহড়ঢ়য়ৎংঃঁ


        ফলে এই হরফে মুদ্রণ-উচ্চতা লাগছে অর্ধেক৤ এতে দৃশ্যত স্থানসাশ্রয় হচ্ছে, ৫০% শতাংশ৤ কিন্তু হিসেব কষে দেখা গেছে যে, স্থানসাশ্রয় ৫০ শতাংশ না হয়ে কিছুটা কমে হচ্ছে, ৪০%শতাংশের কিছু বেশি৤ কারণ বিবিধ হরফ এবং চিহ্ন ইত্যাদি পাশাপাশি বসানোর ফলে আনুভূমিক প্রসারণ ঘটায় পাশের দিকে জায়গা কিছুটা বেশি লাগছে৤ তার ফলে স্থানসাশ্রয় ৫০ থেকে কমে হচ্ছে ৪০%শতাংশ৤ অর্থাৎ এই স্থানসাশ্রয় পরিমাণে বিপুল, এবং এই বিপুল পরিমাণ স্থানসাশ্রয় ঘটছে বাংলা নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা ব্যবহার করার জন্য৤





৩১

        এখানে যেহেতু কোনও মণ্ডহরফ ব্যবহার করা হচ্ছে না তাই, পৃথক করে কোনও যুক্তবর্ণও শিখতে হচ্ছে না৤ এর ফল হচ্ছে এই যে, নতুন শিক্ষার্থী শিশুদের আলাদা করে যুক্তবর্ণ শিখতে হচ্ছে না৤ অর্থাৎ কেবলমাত্র হরফ পরিচয় ঘটলেই একজন শিশু যে-কোনও বাংলা শব্দ অন্তত বানান করে পড়তে পারবে৤ এটা এতদিন ইংরেজি-মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের একচেটিয়া অধিকারে ছিল৤ এখন বাঙালি শিশুরাও তাদের ধরে ফেলল৤ ইংরেজিতে কোন মণ্ডহরফ নেই, হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়েই সকল শব্দ লেখা হয়, তাই হরফ পরিচয় ঘটলেই ইংরেজি মাধ্যমের শিশুরা যেকোনও ইংরেজি শব্দ বানান করে পড়তে পারবে৤ বাংলায় সেটা সম্ভব নয়৤ বাংলা মাধ্যম শিশুরা ক্লাস-টু(Class-II) পাশ করে এলে তবে তারা যেকোনও শব্দ পড়ার ক্ষমতা অর্জন করে, কারণ বাংলায় আছে অন্তত ৩৯৫টি যুক্তবর্ণ৤ যা না-শিখলে সকল বাংলা শব্দ,(এমনকি বানান করেও) পড়া যাবে না৤ 


         আর ক্লাস-টু পেরিয়ে এলে তবেই তারা সকল বাংলা শব্দ পড়তে পারবে বলে ধরে নেওয়া হয়৤ কারণ দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা যুক্তবর্ণ শেখা শেষ হয়৤ হরফ পরিচয় সম্পূর্ণ হতে ধরি ছয় মাস লাগে, তাই তখনই ইংরেজি মাধ্যমের শিশুরা সকল ইংরেজি শব্দ পড়ার যোগ্যতা অর্জন করে৤ ইংরেজি মাধ্যমের শিশুরা কেন দ্রুত এগোয় তা খানিকটা বোধ হয় অনুমান করা গেল৤ কিন্তু বাঙালি শিশুদের অপেক্ষা করতে হয় প্রায় তিন বছর৤ প্রাক-প্রথম শ্রেণি, প্রথম শ্রেণি, এবং দ্বিতীয় শ্রেণি-- এই মোট তিন বছর পড়াশুনার পরে বাঙালি শিশুরা যেকোনও বাংলা শব্দ অন্তত বানান করে পড়তে পারবে(শিশুরা থাক, বাংলায় যুক্তাক্ষরের দাপটে বড়রাও কি সবটা নির্বিঘ্নে পড়তে পারবেন!)৤ 


        কিন্তু বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা ব্যবহার করলে, যেহেতু সেখানে কোনও যুক্তবর্ণ নেই, তাই ছয় মাস পরে, হরফ পরিচয় শেষ হলেই তারা যেকোনও বাংলা শব্দ অন্তত বানান করে পড়তে পারবে৤ তা হলে তাদের সময় সাশ্রয় হবে প্রায় আড়াই বছর৤ বাংলা লিখনব্যবস্থার অ-সরল প্রাচীনত্ব বাঙালি শিশুদের পিছিয়ে রেখেছে৤ সেটা তাদের নিজস্ব অ-যোগ্যতা, বা অ-দক্ষতার কারণে নয়৤ লিখনব্যবস্থা সরল হওয়াতে এবার তারা দ্রুত এগোবে৤ ছাত্রজীবনে আড়াই বছর সময় সাশ্রয় এক বিরাট সাশ্রয়৤ ইংরেজি মাধ্যমের শিশুরা যেমন দ্রুত এগোয়, এবার বাংলা মাধ্যমের শিশুরাও তেমনি দ্রুত এগোবে৤ সারাটা জীবন ধরেই সময় এবং শক্তির এই বিপুল অপচয় বন্ধ হবে, এবং হওয়া উচিত৤ বঙ্গভাষীদের যোগ্যতা কম নয়, দক্ষতা কম নয়, সময় মতো ব্যবস্থা না-নেওয়ায় আমরা বাংলা বানানের এবং লিখনের দুরতিক্রম্য অ-ব্যবস্থাপনায় আটকে আছি, সঠিকভাবে বললে বলতে হয়-- অ-ব্যবস্থাপনায় নিজেদের ইচ্ছে করে আটকে রেখেছি! 

        বাংলায় বিপুলসংখ্যক যুক্তবর্ণ থাকার ফলে বাংলায় হরফের কোনও আলংকারিক রূপ তৈরি হয়নি৤ বাংলায় বর্ণমালার আলংকারিক রূপ তৈরি হবার পথ আটকে রেখেছে ৩৯৫টি যুক্তবর্ণ৤ ঢালাই, খোদাই, সেলাই, কাঠের নামফলক, গ্রিলে লোহার হরফ বা এমনি ধরনের কাজে এতকাল যে বিরাট প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা এবার দূর হল৤ বাংলায় এবার হরফের নতুন নতুন আলংকারিক রূপ দেখা দেবে৤ ইংরেজিতে আছে হরফের হাজার খানেকের উপর আলংকারিক রূপ৤ ইংরেজির হাজার আলংকারিক রূপের কাছে আমরা কত দরিদ্র ছিলাম৤ এবার আশাকরি সে দারিদ্র্য অনেকটা কেটে যাবে৤ 


 ৩২


বাংলা হরফের নতুন দু-একটি আলংকারিক রূপ বরং চাক্ষুষ করা যাক--
(১)বাংলা আধুনিক বর্ণ -- 




(২)বাংলা বিন্দু বর্ণ --




(৩)বাংলা চারু বর্ণ -- 





(৪)বাংলা ডিজিটাল বর্ণ -- 




(৫)বাংলা ডোরা বর্ণ -- 



(৬)বাংলা কারিগরি বর্ণ -- 






সংখ্যা --



         বাংলা নতুন কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার ব্যবহার করার জন্য প্রমিত(Standard) কিবোর্ড ছাড়াও একটি বিতত(Extended) কিবোর্ডও রাখা হয়েছে৤ এতে যেসকল বর্ণ বর্জিত হয়েছে সেসব বর্ণ তো আছেই, অতীত কালের বর্জিত বর্ণ এবং চিহ্নও রাখা হয়েছে, যাতে প্রয়োজন মতো উদাহরণ হিসেবে সেসব পুরোটা(হরফ, সংখ্যা এবং চিহ্ন) দেখানো যায়৤ 


         এছাড়া আছে হরফের নানা আলংকারিক রূপ৤ ইউনিকোড ফন্ট তৈরির আগে নন-ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করতে হয়েছে৤ তবে যেহেতু এখন ইউনিকোড ফন্টই একমাত্র গ্রাহ্য তাই পুরানো সেসব বাতিল নন-ইউনিকোড ফন্ট আর কাজে লাগবে না৤ যদিও সেসব তৈরির পিছনে দীর্ঘ কয়েক বছর সময় কেটেছে৤ 

        আজকাল আমারা দেখি কেমন সুন্দর কৃত্রিম গোলাপ ফুল দোকানে সাজানো থাকে৤ সেগুলো দেখে বোঝা কঠিন যে তা আসল না নকল৤ সুগন্ধি ঢেলে ফুলে সুন্দর গন্ধ মাখিয়ে দিলে তো সোনায় সোহাগা৤ সহসা কে বুঝবে যে তা নকল ফুল! বাংলা বর্ণমালায় তেমনি নকল বর্ণ আছে৤ অআ, ইঈ, উঊ, ঋৠ, ঌৡ -- ইত্যাদি জোড়া জোড়া বর্ণ কি বাংলা বর্ণমালায় সত্যিই আছে? সত্যিই থাকতে পারে? 


        এটা কি কৃত্রিম নয়! কিন্তু তা দেখে, বা গন্ধ শুঁকে বোঝা কঠিন যে, তা কৃত্রিম৤ কৃত্রিম গোলাপ দেখে বোঝা কঠিন যে, তা কেবলই চোখ ভোলানো, কেবলই মন ভোলানো৻ আসলের সঙ্গে তার অনেক তফাত৤ 

        বাংলার বাউল ফকির  লোক-অঙ্গনের নিভৃতে নতুন-বাংলাকে এনে পরখ করে দেখতে হবে তা লোকজীবনের নিকানো আঙিনায় কেমন খাপ খায়৤ সাদামাটা সরল জীবনকে তা কতটা অন্তরঙ্গ উচ্চারণে গ্রহণ করে৤ পরখ করে দেখতে হবে লোকজীবনের বাইরেই-বা তা বঙ্গজীবনকে কতটা খরদড় করে৤

(এর পরে দ্বিতীয় অংশ, পৃঃ-৩৩ )
প্রথম অংশ সমাপ্ত৤



সর্বশেষ পরিমার্জন ১৪/১০/২০১৮


দ্বিতীয় অংশ দেখুন 
লিংক:
http://banglainternational.blogspot.in/2014/04/bangla-bhasha-sanskar_30.html








লেবেলসমূহ:

0টি মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এতে সদস্যতা মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন [Atom]

<< হোম