শনিবার, ৩ মে, ২০১৪

বাংলাভাষা সংস্কার Bangla Bhasha Sanskar চতুর্থ অংশ


বাংলাভাষা সংস্কার Bangla Bhasha Sanskar 
চতুর্থ অংশ [মোট ৪টি অংশ]


বাংলা ইন্টারন্যাশনাল ব্লগে প্রকাশিত

পূর্বে প্রকাশিত নিবন্ধটি সর্বাধুনিক অহনলিপি-বাংলা১৪ইউনিকোড ফন্টে পুনর্লিখিত হল(মার্চ ২০১৪)
(Recomposed in "AhanLipi-Bangla14"  Unicode font)


বাংলাভাষা সংস্কার

মনোজকুমার দ. গিরিশ
(মনোজকুমার দীনেশচন্দ্র গিরিশ)

মোট ৮৪ পৃষ্ঠা
চতুর্থ অংশ -- পৃঃ ৫৭-৮৪)




লেখাটি অহনলিপি-বাংলা১৪ AhanLipi-Bangla14 ফন্টেই পড়তে হবে
ফন্ট প্যাকেজ ফ্রি ডাউনলোড লিংক:
 https://sites.google.com/site/ahanlipi/font-download/AhanLipi-Bangla14.zip

কিংবা

https://sites.google.com/site/ahanlipi/



৫৭

        বাংলাভাষার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের ইতিহাস৤ বাংলাভাষার জন্ম প্রায় এক হাজার বছর আগে৤ কিন্তু মানুষের মতো ভাষার তো কোনও একটা নির্দিষ্ট জন্মদিন থাকতে পারে না৤ বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে তার রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৤ তখন একটা সময়পর্বকে বলা হয় তার জন্মকাল৤ তাই প্রায় এক হাজার খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার জন্ম বলে ধরা হয়৤ কেউ কেউ তাকে আর একটু প্রাচীন বলে মনে করেন৤  

        বাংলাভাষার উদ্ভব বিষয়ে যে ছক দেখানো হয়েছে তার শেষ দিকে ৮ম -- ১১শতকে মাগধী অপভ্রংশের পূর্বী শাখাকে বলা হয়েছে প্রত্ন বাংলা৤ অর্থাৎ এই সময়কার ভাষার মধ্যে বাংলাভাষার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে৤ এই স্তর হল নব্য ভারতীয়-আর্য ভাষা স্তর৤ যার পরিব্যাপ্তি হল খ্রিস্টিয় দশম শতক থেকে আধুনিক কাল অবধি৤ প্রদর্শিত ছক থেকে দেখা যাবে  সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার আত্মীয়তা কতটা দূর বা ঘনিষ্ঠ৤ সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার জ্ঞাতি সম্পর্ক, সরাসরি জননী সম্পর্ক নয়৤ অতি দূর পূর্বদেশের এই জল জঙ্গল জলৌকা(জোঁক) সমাকীর্ণ অঞ্চলে বহিরাগত আর্যরা এসেছে অনেক পরে৤ তাদের প্রভাব এতদ্‌ অঞ্চলে তাই কমই৤ বাঙালিরা মিশ্র জাতি৤ বহু জাতি গোষ্ঠীর রক্ত এসে মিশেছে বাঙালি জাতির মধ্যে৤ তাই বিশুদ্ধতার গর্ব, যা নিয়ে অন্য অঞ্চলের লোকেরা মাতামাতি করে তা বাঙালির নেই৤ এই না-থাকাটাই বাঙালির পক্ষে মঙ্গল৤ তাই বাঙালি বহু রক্তের মিশ্রণে মেধাসম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে৤ নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার করলে এই মিশ্রণ মেধার বিকাশে সহায়ক৤ বাঙালিরা তাই সহজ মেধা-সম্পন্ন জাতি৤ বাঙালির তাই সংকীর্ণতা নেই, সে তাই উদার এবং সহজে বিশ্বভারতীয় হয়ে উঠতে পেরেছে৤ 

        প্রধান তিনটি জনশ্রেণি-- অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোল সভ্যতা দ্বারা পুষ্ট হয়েছে বাঙালি,  পরে তার উপরে এসে পড়েছে আর্য প্রভাব৤ তাই বাঙালির মধ্যে সকল এই শ্রেণিরই প্রভাব দেখা যায়৤ লৌকিক সংস্কৃতি, আচার-আচরণ থেকে বিহিত পূজা-প্রকরণ সব কিছুর মধ্যেই তাই এসবের প্রভাব ফুটে উঠতে দেখা যায়৤ এসব বাঙালির অপার ঐতিহ্য৤ কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা নরশ্রেণি এবং একটি বিশেষ সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতায় বাঙালি তাই আটকে নেই৤ বিশ্ব-মানবপুষ্টি ভারতীয় অন্য আর কোন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এতখানি নেই৤ লক্ষণীয় বিষয় হল, তবু বাঙালি নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি ও আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল৤ 

        ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বাঙালির শিকড় তাই অনেক ব্যাপ্ত এবং গভীর৤ অনেক বিবর্তনের জোয়ার বয়ে গেছে তার এই নরম পলির উপর দিয়ে৤ তাই সব ঐতিহ্যের শিকড় তার মূলে বিধৃত৤ বৈষ্ণব পদাবলির অমিয় কবিকূল থেকে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল, জসিম উদ্দিন, লালন, চারুশিল্পী যামিনী রায়, জয়নাল আবেদিন প্রমুখ এবং তিনটি নোবেল পুরস্কার(সাহিত্য, অর্থ, শান্তি), চলচ্চিত্রে অস্কার পুরস্কার, সাংবাদিকতায় ম্যাগসাইসাই পুরস্কার তাই বাঙালির গৌরবের মুকুটে শোভা পায়৤ 



 ৫৮

        বাংলাভাষা ও বানান সংস্কারের পরে যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে, তখন সেই লিপি বা বানানে সংস্কৃত লেখা হবে কেমন করে, সে এক জরুরি প্রশ্ন৤ প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য চর্চার তাগিদে বর্তমানে প্রচলিত যে ভাষা, যা জীবন-জীবিকার সূত্র, জীবনচর্যার উৎস-- তাকে তো আর সেকারণে প্রাচীনত্বের নিগড়ে বেঁধে রাখা যেতে পারে না, কিংবা সেই সুবাদে বাংলাভাষার সমৃদ্ধিকে বিসর্জন দেওয়া চলে না৤ রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দীন তো বাংলারই৤ কেবলমাত্র প্রাচীন ভাষার সাহিত্যরস চর্চার উৎসাহে বা প্রয়োজনে, এটা মানা যায় না৤ এ যুগের ভাষা, বহমান-- চলমান আধুনিক ভাষা বাংলার সংস্কার তাই বন্ধ রাখা যাবে না৤ এর সঙ্গে বাংলাভাষার অগ্রগতি ও ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রশ্ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, বাস্তবত জীবন-জীবিকারই প্রশ্ন, তাই বাংলাভাষা সংস্কারের কোনও কাজই বন্ধ রাখা যাবে না৤ আধুনিক কম্পিউটার ও e-যুগের সঙ্গে তাল রেখে বাংলাভাষাকে চলতে হবে, তাই তার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করা যাবে না৤ 

        বাংলাভাষার মুদ্রণ শুর হয়েছে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে(১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধের ২১ বছর পরে)৤ কোলকাতা থেকে একটু দূরে শ্রীরামপুরে যার সূচনা৤ শুরুটা হয়েছে ইংরেজদের হাতে৤ যদিও পঞ্চানন কর্মকার(মল্লিক?) ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে এ উদ্দেশ্যে ছেনি দিয়ে লোহা কেটে হরফ তৈরি করেন৤ অনেক পরে(১৫৭ বছর পরে) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় মেশিনে লাইনো কম্পোজিং৤ সেটার সূচনাও আসলে বিদেশিদের হাতেই৤ যদিও সুরেশচন্দ্র মজুমদার হরফের গঠন এবং বানান ইত্যাদি অন্যান্য প্রয়োগের বিষয়টি প্রস্তুত করেন৤(অন্য একটি তথ্য থেকে দেখা যায় যে, অজরচন্দ্র সরকার মূলত বিষয়টির প্রবক্তা, বর্ণপরিচয়(পত্রিকা), নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০০৯, পৃঃ ২৩১-৩৬, বাংলা টাইপ ও কেস, অজরচন্দ্র সরকার৤ সেখানে একটি কথা খুব গুরত্বপূর্ণ--‘পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করিতে গিয়া আমাকে পুনঃ পুনঃ বলিতে হইয়াছিল যে, বাঙ্গালা বানান ঠিক না হইলে বাঙ্গালা টাইপ ও কেসের সংস্কার হইতেই পারে না’)৤ সুরেশচন্দ্র বলেন, “বাঙ্গলা অক্ষর লাইনোটাইপের উপযোগী করিবার জন্য কার্যক্ষেত্রে অসুবিধাগুলির প্রতি আমার দৃষ্টি রাখিতে হইয়াছে, সুতরাং প্রচলিত অক্ষর গঠন রীতির কিছু কিছু পরিবর্তন করিতে হইয়াছে৤ ... উন্নতির অনেক রহিয়াছে৤” পরে এই কিছুদিন মাত্র আগে বিংশ শতকের একেবারে শেষ পাদে(লাইনো টাইপের প্রায় পাঁচ দশক পরে) শুরু হয় কম্পিউটার কম্পোজিং৤ সেটিও বিদেশে বিদেশিদের হাতে তৈরি৤ প্রথম বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি করে ডক্টরেট হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সমর ভট্টাচার্য(আশির দশকে)৤ পরে নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি একটি বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি করে নিতে পারি, এ ব্যাপারে সমরবাবুর পরামর্শ পাবারও কিছুটা চেষ্টা করেছি৤ বাংলা নতুন-বানান বাস্তবে প্রয়োগ করতে হলে তা ছাপানো দরকার৤ অবশ্য হাতে কম্পোজ করার ছাপাখানায় কাজটি করা যাচ্ছিল, কিন্তু হাতে কম্পোজের ছাপাখানার দিন শেষ হয়ে এসেছে, তাই লাইনো মেশিন, টাইপরাইটার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন বানানে টাইপ-ব্যবস্থা তৈরি করে নেবার চেষ্টা চলে, কিন্তু তার ব্যয় বিপুল৤ তাই এসব অপ্রতুল মুদ্রণব্যবস্থা ও বিপুল ব্যয়ের সমস্যা এড়াবার জন্য কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি করাই ছিল উত্তম সামাধান৤ 




৫৯

        বাংলা নতুন-বানান লিখবার জন্য প্রথমে ডস্‌(DOS- Disc/Disk Operating System) ভিত্তিক যে বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি করি, তার অনেকই সীমাবদ্ধতা ছিল৤ তাই পরে আরও আধুনিক উইন্ডোজ-৯৮(WINDOWS-98) এলে তাকে ভিত্তি করে আর একটি বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি করি৤ এবারে বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরিতে সহায়তা করে আমার পুত্র অবনশিখর৤ সেই কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যারের সাহায্যেই এই নিবন্ধের উদাহরণগুলির বিনীত উপস্থাপন৤ পরে অবশ্য তৈরি করি উইন্ডোজ৭[WINDOWS7] ভিত্তিক আরও উন্নত বাংলা ইউনিকোড ওপেন টাইপ ইউআই ফন্ট, এবং কিবোর্ড৤ এটি আন্তর্জাতিক ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের প্রবর্তিত ইউনিকোড Unicode™ Standard  অনুসরণ করে তৈরি করা৤ 

        যে হরফগুলি বাতিল করা হয়েছে সেগুলি যদি কখনও উদাহরণ হিসেবে দেখাতে হয় তবে সেগুলিকে যাতে দেখানো যায়, সে উদ্দেশ্যে একটি অতিরিক্ত কিবোর্ড তৈরি করা হয়েছে৤ মূল প্রমিত(Standard) কিবোর্ড, এবং একটি বিতত(Extended) কিবোর্ড নিয়ে এই বাংলা বানানের কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরি হয়েছে৤ অবশ্য এদুটি আলাদা কিবোর্ড নয়, একটি কিবোর্ডকেই দুটি ভাগে দেখানো হয়েছে৤ ব্যবহার করলেই বোঝা যাবে৤ বাংলা নতুন-বানানের কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যারটি যাতে সকল বাংলাভাষী ফ্রি ডাউনলোড করে নিতে পারেন সেজন্য লিংক হল: https://sites.google.com/site/ahanlipi/font-download/AhanLipi-Bangla14.zip সর্বান্তিক এই ইউনিকোড ফন্টটির নাম হল, ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ AhanLipi-Bangla14,  এটি ১লা জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে আপডেট করা হয়েছে৤ এই ফন্টটি দিয়ে চলতি বানান তো লেখা যাবেই, নতুন বানানও লেখা যাবে, তেমনভাবেই এটি গঠিত৤ 

        আর একটি লিংক হল:
https://sites.google.com/site/ahanlipi/home/bangla-natun-banan-font/AALOY-FontGroup2014.zip

এগুলি আলংকারিক ফন্ট এবং এই ফন্টগুলি দিয়ে কেবল নতুন-বানানই লেখা যাবে৤ 


        অ-প্রচলিত হয়ে যাওয়া প্রাচীন হরফ যেমন-- ৠ(দীর্ঘ ঋ), ঌ(লি), ৡ(দীর্ঘ লি), অথবা অহমিয়া(ওয়--অন্তঃস্থ-ব), এবং অহমিয়া ‘র’ তথা পেট কাটা-ব(), সংস্কৃত লুপ্ত-হ(), নতুন সৃষ্ট বাংলাদেশি টাকার চিহ্ন(), ভারতীয় রুপি চিহ্ন(), বিদেশি আরও মুদ্রা চিহ্ন (ডলার $, পাউন্ড £, ইয়েন ¥, ইউরো ), পুরানো মুদ্রা চিহ্ন (৴ ৵ ৶ ৷ ৸), ডাক্তারি চিহ্ন(), কপিরাইট(©), রেজিস্ট্রেশন(®), পার্কিং(), ট্রেড মার্ক(), রেড/হোয়াইট ক্রস( ), যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, অসম, টিক(+ - × ÷ ≠ ⊨), ত্রিভুজ, গোল( ), অর্ধরুদ্ধ, রুদ্ধ(  ) ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই এখানে রাখা আছে৤ 

        ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্টে মণ্ড হরফ হিসেবে কেবল ক্ষ, জ্ঞ ছাড়া আর অন্য কোনও মণ্ডহরফ নেই৤ সংস্কৃত লেখার দু-একটা উদাহরণ দেখা যাক--অর্পণ, অগণন, কার্য, মুহূর্ত, মণ্ড, সংস্কৃত, ক্‍ঌপ্ত, পিতৄণ, পৌত্তলিক৤  

        বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা প্রধানত ছাপার কাজের জন্য ব্যবহার করা হবে৤ হাতে করে লেখার পক্ষে এ হরফ তেমন সুবিধেজনক নয়৤ ইংরেজিতে যেমন ক্যাপিটাল লেটারে লেখা হয় না, হাতে লেখার জন্য স্মল লেটারই ঠিক৤ তেমনি বাংলায় চালু হরফই হাতে লেখার জন্য ঠিক, আর ছাপার কাজে বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা ব্যবহার করা হবে৤ তাতে ছাপা পরিচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট হবে৤ বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা প্রধানত তৈরি করা হয়েছে আয়তাকার গঠনের৤ এটিই বাংলা হরফের সবচেয়ে সরল রূপ৤ ভবিষ্যতে এটি হাতে করে লেখা যাবে কিনা, তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে৤ 




৬০

        এ হরফ যখন গঠন করা হয়(১৯৭০ নাগাদ), তখন আয়তাকার ছাড়া অন্য ধরনের রূপও দেওয়া হয়েছিল৤ কিন্তু তা আয়তাকার তথা নির্দিষ্ট রূপ না-হবার জন্য, সেসব রূপ বর্জন করা হয়েছে৤ এই বর্জন-প্রক্রিয়ার জন্য আমাকে অনেক মানসিক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে, কারণ সেসব রূপ হয়েছিল খুবই মনোহারী, কিন্তু আয়তাকার সরল গঠনের যে শর্ত-- তার বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়নি৤ অবশ্য রূপায়িত বর্তমান হরফগুলির কোণাগুলি যদি গোলাকার করা যায়, তবে এই হরফগুলিই অনেক বেশি সুন্দর লাগবে৤ সেটা কেউ করলে বেশ হবে৤ তবে অবশ্যই তা হরফের মূল চরিত্র বজায় রেখেই করতে হবে৤ 

        হরফ গঠন-- 








        একাধিক শব্দের বানান একই হয়ে অর্থ বিভ্রাট ঘটাবে কিনা?-- শব্দের অর্থ প্রকাশিত হয় তার প্রতিবেশ(Context) থেকে৤ বহু শব্দ এখনও চালু আছে যাদের অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা, বানান কিন্তু একই৤ সেখানে ব্যবহার বা প্রতিবেশ থেকে অর্থ বুঝতে হয়৤ সেসব ক্ষেত্রে অসুবিধা এখনও যেমন হয় না, নতুন ক্ষেত্রেও তেমনি কোনও অসুবিধা হবে না৤ তবে নতুন ব্যবস্থায় একই বানানে বিভিন্ন অর্থযুক্ত শব্দের সংখ্যা কিছুটা বাড়বে৤ যদিও তা কিন্তু খুব বেশি বাড়বে না, হিসেব কষে দেখা গেছে সেরকম বৃদ্ধি মাত্র ০.২% শতাংশ৤ 

        বর্তমানের সবচেয়ে মনস্ক ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক পবিত্র সরকার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি করেছেন-- ‘একটি ভাষায় সদৃশরূপী শব্দের সংখ্যা কত বেশি হতে পারে তারও একটা সীমা আছে৤ যাঁরা বানাননীতি নতুন করে নির্ধারণ করবেন তাঁদের এই দিকে বিশেষ করে দৃষ্টি দিতে হবে৤’ বাংলায় আছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ, এবং তাতে সদৃশরূপী শব্দের সংখ্যা প্রায় ৬০০, অর্থাৎ প্রায় ০.৪%শতাংশ৤ বানান সংস্কারের পরে তা ৩০০ বেড়ে দাঁড়াবে ৯০০, অর্থাৎ ০.২% শতাংশ বেড়ে মোট হবে ০.৬% শতাংশ৤ এই বৃদ্ধিটা খুব সামান্য কি? যদি সামান্য হয়ও, তাহলেও তা বিপজ্জনক কিনা তা চিন্তাবিদেরা-- জ্ঞানচারীগণ ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখুন৤ 

        শব্দের অর্থ-বোধ্যতার প্রসঙ্গে একটি অভিধান থেকে তাঁদের অভিমত উল্লেখ করি--
" Often  words  have many  meanings,  and  the  exact  meaning  of  a  word  can  only  be    determined  from  the surrounding context" -- The Chambers Dictionary, P-VII (1996)৤ 


        ইংরেজিতে যেমন-- I saw a saw to saw a tree বলে বিভিন্ন অর্থের একই বানানযুক্ত শব্দ নিয়ে কৌতুক করা হয়, বাংলায় তেমনি বলা যেতে পারে-- ‘ঘরে নেই চাল, তবু তার চালে অন্যের ঘরের চাল ফুটো হয়, চালচুলোহীন লোকেরা তবু পাশার চাল ছেড়ে উঠতে চায় না’৤ 

        খুঁজলে দেখা যাবে এক-একটা শব্দের এমনি একাধিক অর্থ আছে, চাল--৬ রকম অর্থ, রস-- ৮রকম অর্থ, কথা-- ১১ রকম অর্থ, পাট-- ১৪ রকম অর্থ ইত্যাদি৤ 

        বাংলা নতুন বানান নিয়ে প্রশ্ন কি কেবল এ কটা? প্রশ্ন আছে শত শত৤ মোটে তার দু’একটা আলোচনা করা হল৤ পাঠকের মনে যেসব প্রশ্ন আছে, সেসব তাঁরা তুলুন৤ সব প্রশ্নের সমাধান করে তবেই তো এগোনো ঠিক৤ তা না হলে পথ হারিয়ে যাবে যে৤ প্রশ্ন মানেই সন্দেহ, আর মনে সন্দেহ রেখে এগোনো চলে না৤ তাছাড়া, যেসকল সমস্যার সমাধান করা হয়নি, বা আদৌ ভাবা হয়নি, সেসবের তো সমাধান আগে করে নিতে হবে৤ সুতরাং প্রশ্ন করুন, মন খুলে প্রশ্ন করুন৤ সে সবের হাতে-হাতে সমাধান করা না গেলেও, অর্থাৎ আগে থেকে ভাবা না হলেও, ভেবে চিন্তে সে সবের সমাধান বের করতেই হবে, তবেই নিশ্চিন্ত মনে এগোনো যাবে৤ এই প্রস্তাবের উত্থাপক হিসেবে সব প্রশ্নের উত্তর যে একমাত্র আমাকেই দিতে হবে এমন নয়৤ জ্ঞানচারী বোদ্ধা পাঠকেরাও নিজেদের মেধা, অধীত বিদ্যাবুদ্ধি এবং দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থেকে তার সমাধান তুলে ধরবেন, এবং এভাবেই যৌথ উদ্যোগেই বাংলা বানান সংস্কারের প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে হবে৤ প্রয়োজন এবং স্বার্থ যে আমাদের সবার সমান৤ 




 ৬১

        বাংলা বানান উচ্চারণ-ভিত্তিক করতে হলে-- বাংলা জানা (১)অ-বাঙালি দক্ষিণ ভারতীয়, (২)অ-বাঙালি উত্তর ভারতীয়, এবং (৩) বাংলা জানা বিদেশিদের সম্মিলিত টিমের বাংলা পাঠ ও উচ্চারণের নিবিড় সহায়তা নিতে হবে৤ কারণ, বাঙালিরা লিখিত বাংলাশব্দ বানান করে পড়ে না৤শব্দটি দেখে উচ্চারণ করে, বা স্রেফ অভ্যাসবশে পড়ে৤ উচ্চারণের সঙ্গে লিখিত শব্দের অনেক সময়ই তাই কোনওই মিল থাকে না৤ অ-বাঙালি এবং বিদেশিরা তেমন না-করে বরং বানান ধরে পড়েন,ফলে শব্দের বানানটি আসলে কোন্‌ ‘উচ্চারণ’ নির্দেশ করছে তা এর ফলে স্পষ্ট জানা যাবে, এবং তখন শব্দটির বানান সংশোধন করে যথাযথভাবে উচ্চারণ-ভিত্তিক করে লিখতে হবে৤ সেটা একশ’ ভাগ না হোক ৯৫ ভাগ হলেই হবে৤ এটি একটি বিরাট কাজ হলেও, এ কাজটি না করলে বাংলা বানান সংস্কারের প্রকল্প সম্পূর্ণ হবে না৤ 

        বাংলাভাষা ও বানানে কী-কী সংস্কার করা হল, তার একটি তালিকা করা যাক৤ তবে, এসব সংস্কারের সবগুলি একত্রে, এবং একবারে প্রয়োগ করলে চলবে না৤ বারবার একথা উল্লেখ করা হয়েছে৤ খুব ধীরে, জীবনের তাল ও লয়ের সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়া প্রয়োগ করতে হবে৤ স্বাভাবিক অভ্যাসের সঙ্গে একটি সংস্কার আত্মস্থ হলে, পরবর্তী ধাপে যেতে হবে৤ দেখতে হবে যেন অকারণ বিরোধিতার পথ প্রশস্ত করা না হয়৤ আমাদের উদ্দেশ্য তো বাংলা ভাষা ও বানানকে সংস্কার করে তাকে--  সুন্দর, সুসংহত, উন্নত, ঋজু, আধুনিক ও গতিশীল এবং সহজে ব্যবহার্য করে তোলা-- তা লেখায়, পড়ায়, ছাপায়-- সর্বত্র৤ 

এজন্য বাংলাভাষা সংস্কারের বিষয়গুলি হল-- (১)বানান, (২)আঙ্গিক, (৩)অবয়ব৤ 
 
বানানের মধ্যে থাকছে-- (১.১)বর্ণমালার সংস্কার-- গ্রহণ, বর্জন (১.২)লিপি-- নির্মাণ৤  
আঙ্গিকের মধ্যে থাকছে-- (২.১)বর্ণমালার সজ্জা, (২.২)লিখন পদ্ধতি৤ 
 
অবয়বের মধ্যে থাকছে-- (৩.১)লিপির গঠন, (৩.২)যুক্তবর্ণ সংগঠন৤ 
 
অর্থাৎ বাংলাভাষা সংস্কারের কাজ বহুস্তরীয়, এবং বহুমাত্রিক ও বিচিত্র৤ এগুলি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে৤ 

        অতি সংক্ষেপে এসবের আবার একটু উল্লেখ করা যাক:--
বানান-- (১.১)বর্ণমালা সংস্কার-- গ্রহণএা(এাক=১),এবং বর্জনঈঊঋঐঔ, ঞণযৱষ(৫+৫=১০)
        (১.২)লিপি নির্মাণ-- এা, ৙঄, (অ=)৹  
আঙ্গিক--(২.১)বর্ণমালার সজ্জা-- স্বরবর্ণউওঅআএাএই(৭),স্বরচিহ্ন-- ু ৗ ৹ া ৙঄ ৙ ী
           ব্যঞ্জনবর্ণহকখগঘঙয়টঠডঢড়ঢ়চছজঝশনরলসতথদধপফবভম ঃ ং ঁ ৎ(৩৫) 
        (২.২)লিখন পদ্ধতি-- লীপী, দ৙শ,ব৙঄গ,কৗল৤ হাতে সহজে লেখার জন্য    








অবয়ব-- (৩.১)লিপির গঠন-- 













( অআইউএএাও  কখগঘঙ  চছজঝটঠডঢ  তথদধন 
পফবভমরল   শসহড়ঢ়য়ৎ ংঃঁ ) 


        (৩.২)যুক্তবর্ণ সংগঠন-- গল্প, শক্ত, খদ্দর



৬২

        ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(১৮২০--১৮৯১, আয়ুষ্কাল ৭২ বছর) মহাশয় ৩৬ বছর বয়সে যখন বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ প্রকাশ করেন(বঙ্গাব্দ ১২৬২, ইং ১৩ এপ্রিল ১৮৫৫; ১লা বৈশাখ, সংবৎ ১৯১২ --দিনটি সম্ভবত ছিল বাংলা ৩০ চৈত্র, অর্থৎ বাংলা নববর্ষ ১২৬৩-এর পূর্বের দিন) তখন তিনি বাংলাভাষার সংস্কারও করেন৤ শিশুদের বর্ণ পরিচয় করানোর জন্য নিতান্ত শিশুপাঠ হলেও বর্ণপরিচয়  প্রকাশ বাংলাভাষার পক্ষে এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা৤ বিদ্যাসাগরের আমলে স্বরবর্ণ ছিল ১৬টি, এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি৤ এই মোট ৫০টি বর্ণে বাংলা বর্ণমালা গঠিত৤ 

তখন,
স্বরবর্ণ ছিল-- অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ ৠ ঌ ৡ এ ঐ ও ঔ অ৹(=অং) অঃ-- মোট ১৬টি৤
ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল-- ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র ল ব শ ষ স হ ক্ষ --মোট ৩৪ ব্যঞ্জনবর্ণ৤ 

        এই বর্ণমালা থেকে বিদ্যাসাগর বর্ণ-- (১)গ্রহণ[ঁ], (২)বর্জন[ৠ ৄ ৡ ৣ  ক্ষ], (৩) নির্মাণ[ড় ঢ় য়], এবং (৪)পুনর্বিন্যাস[ং ঃ (স্বরবর্ণ থেকে ব্যঞ্জনবর্ণে), ঁ (স্বতন্ত্র বর্ণ, নব নির্মাণই বলা যায়), এবং ‘ক্ষ’ যুক্তবর্ণ বলে অসংযুক্ত বর্ণমালা থেকে বাতিল] করে তিনি বাংলাভাষাকে দৃঢ়ভিত্তি দেন৤
[বিদ্যাসাগরের জন্মের(১৮২০) ৪২ বছর আগে  ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ হ্যালহেড সাহেব Nathaniel Brassey Halhed ইংরেজিতে যে বাংলা ব্যাকরণ বই প্রকাশ করেন, A Grammar of the Bengal language, সেখানে প্রথম বাংলা বিচল(movable) হরফে ছাপা বহু উদাহরণ দেন৤ সেই গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে যে, চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারে আছে প্রদর্শিত বর্ণমালায় নেই, পৃঃ-৯১; ড়,য় ব্যবহারে আছে প্রদর্শিত বর্ণমালায় নেই, পৃঃ-৩২, এমনকি গ্রন্থের প্রচ্ছদেও ‘য়’ আছে; বর্ণমালার কিছু বর্ণের গঠনে তৎকালে দু-তিনটি রূপ পাওয়া যায়-- র/ব/ৰ ] 

        বিদ্যাসাগরের হাতে বর্ণমালা সংগঠনের পরে বাংলা বর্ণমালা হয়-- স্বরবর্ণ ১২, ব্যঞ্জনবর্ণ ৪০, এই মোট ৫২ বর্ণ৤ পরে বাংলা বর্ণমালা থেকে  ব্যবহারের অভাবে ঌ(লি) বর্ণটি অলক্ষ্যে আপনিই বর্জিত হয়ে যায়৤ ফলে স্বরবর্ণ হয় ১১টি, আর তাই বাংলা বর্ণমালা হয় ১১+৪০=৫১টি বর্ণ নিয়ে গঠিত৤ 


        বাংলায় আছে বর্গীয় ব, এবং অন্তঃস্থ-ব(ৱ)৤ বাংলায় এই দুটি ব-এর লিপি গঠনে কিংবা উচ্চারিত বর্ণে কোনও পার্থক্য নেই, বর্ণমালায় কেবলমাত্র তার নির্দিষ্ট অবস্থানই আছে৤ তাই বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের সর্বশেষ উদ্যোগ দেখি এ যুগে ১৯৮১-তে যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বর্ণমালা থেকে অন্তঃস্থ-ব বর্জন করে৤ এখন বাংলা বর্ণমালায় আছে ১১ স্বরবর্ণ, এবং ৩৯ ব্যঞ্জনবর্ণ, এই মোট ৫০টি বর্ণ৤ মোট সংখ্যায় বিদ্যাসাগরের ঠিক আগেও বাংলা বর্ণমালা ৫০টি বর্ণে গঠিত ছিল৤ 


        নানা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাভাষার সত্য-সংস্কার হয়নি৤ তা হয়েছে বড় জোর ধুলো ঝাড়া, বা গা-মোছা৤ কিন্তু অবগাহন-স্নান করে পরিশুদ্ধ হবার জোরালো প্রস্তাব দিয়েছিলেন “পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি”(১৯৪৯), এবং প্রায় একই ধরনের প্রস্তাব দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিভাষার অধ্যাপক(প্রয়াত) ডঃ জগন্নাথ চক্রবর্তী “দেশ” সাহিত্যপত্রে এক নিবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে(১১-০৩-১৯৭৮)৤ এ দুটিই ছিল বাংলাভাষার সত্যিকারের সংস্কার-প্রস্তাব৤ কিন্তু নানা কারণে তা কার্যকর হয়নি, বা কার্যকর করা যায়নি৤ সে প্রস্তাবসমূহ কার্যকর করা গেলে বাংলাভাষা এক বিরাট লাফ দিয়ে বহুদূরে এগিয়ে যেত৤  


 ৬৩

          বাংলাভাষা সংস্কারের চেষ্টায় উদ্যোগ অনেকে নিয়েছেন এবং প্রস্তাবও অনেকে দিয়েছেন, এমনকি বিদেশিরা অবধি প্রস্তাব দিয়েছেন৤ বিদ্যাসাগরের আমলে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের দশ বছর পরে জন মারডক(John Murdoch) বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এক পত্রে (২২-০২-১৮৬৫) বাংলাভাষা সংস্কারের এক প্রস্তাব দেন৤ বাংলা মুদ্রণের চারযুগ নিবন্ধে বরুণকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা মুদ্রণ সহজতর করার জন্য ক্রিশ্চিয়ান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির এজেন্ট পাদ্রি জন মারডক ভাবনা ও প্রযত্নের কথা এখানে উল্লেখ্য স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশনায় দীর্ঘকাল যুক্ত থেকে তিনি বাংলাভাষার প্রয়োগশৈলীতে যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হন তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে বাংলা অক্ষর সংস্কারের কয়েকটি প্রস্তাব করেন” (দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা-- আনন্দ পাবলিশার্স, পৃঃ-১০০)৤ জন মারডকের এই চটি বইখানি নিয়ে একটি কথা বলি৤ কোলকাতার ভারতীয় জাতীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের সন্ধান করতে গেলাম যেখানে বাংলা বর্ণের তুলনাংক(letter frequency) পাওয়া যাবে৤ নানা বই খুঁজে তার হদিস পেলাম না৤ তখন অন্য ধরনের বই খুঁজতে গিয়ে একখানি বই পেলাম যেটি আমার কাজে লাগতে পারে ভেবে পড়তে চাইলাম৤ বইটি খুবই কাজের, সেটি এই বইখানি, জন মারডকের (Letter to Babu Iswarchandra Vidyasagar on Bengali Typography--John Murdoch), আমি খুঁজছিলাম লেটার ফ্রিকোয়েন্সি(Letter Frequency), সেখানে পেলাম letter তালিকায় এই বইটি৤ শুধু তাই নয় বইটির তালিকার বয়ানে ভুল ছিল, আমি দেখে তা সংশোধন করে দিই, সে বই পূর্ববর্তী অন্যদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া কঠিনই ছিল৤ পরের লোকেরা যাতে সহজে বইটি খুঁজে পান সেজন্য সংশোধন করে দেওয়া৤ বইয়ের কার্ডটির অবস্থা দেখে মনে হয়নি তা অন্য কেউ দেখেছেন, তাহলে তিনি তালিকার বয়ান শুধরে দিতেন৤ আমি বইটি পেয়েছিলাম এলোপাথাড়ি খুঁজতে গিয়ে৤ 


        বাংলাভাষা ও বানান সংস্কার নিয়ে নানা পত্র-পত্রিকায় নানা সময়ে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, এবং বইও প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সংস্কার-কাজ বিশেষ এগোয়নি৤ এগোয়নি কারণ বাংলাভাষা সংস্কারের বহুমাত্রিক দিক আছে৤ সবগুলি দিক একত্রে বিবেচিত না হলে বৈপল্বিক পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না৤ 

      প্রথমে আলোচনা করা দরকার বাংলাভাষা ও বানানে কেন সংস্কার করা দরকার? তারপরে দেখতে হবে কতটুকু এবং কী-কী সংস্কার করতে হবে, এবং শেষে আলোচনা করতে হবে, কীভাবে তা কার্যকর করতে হবে, কতদিন বসে সে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে, কারাইবা কাজটি করবেন? 

        ভাষা হল মানুষের আত্মপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম৤ অন্যান্য প্রাণীরও “ভাষা” আছে৤ গরু কুকুর ছাগল কাক হাঁস যে-শব্দ করে তা-ই এদের ভাষা৤ আমরা বলি এসব এদের “ডাক”৤ মুখে উচ্চারিত যে অর্থবহ কথা বলা হয় সেটাই হল ভাষা  লিখিত রূপ হল ভাষাকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার ‘কৃত্রিম প্রচেষ্টা’৤ লেখার সৃষ্টি হয়েছে ভাষা সৃষ্টির বহু বহু পরে৤ পৃথিবীতে-- এমনকি ভারতেও বহু ভাষা আছে যা এখনও শ্রুতি-- যা এখনও লিখিতভাষা হয়ে ওঠেনি৤  

        দূর অতীতে সংস্কৃত ভাষাও এক কালে ছিল শ্রুতি৤ বেদ মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, তাই বেদের আর এক নাম “শ্রুতি”৤ বাইরে থেকে আসা, ভারতে প্রবেশকারী অর্ধ-সভ্য যোদ্ধা যাযাবর জাতিদের মধ্যে যে-কালে (প্রাক)সংস্কৃত ভাষা কেবলমাত্র শ্রুতি হিসেব প্রচলিত ছিল, সে সময়ে তা যে খুব উন্নত ছিল একথা বোধহয় বলা চলে না৤ পরবর্তীকালে সে-ভাষাই ভারতের ভাষাসমূহের সঙ্গে সংমিশ্রণের ফলে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে perfect language for all time  বলে অভিনন্দিত হয়েছে৤ 




৬৪

        মানুষ মুখে যেমন যেমন কথা বলে, লেখার কাজ হল তা ঠিক ঠিক তেমনি ভাবে ধরে রাখা  (লিপির ভূমিকা স্টেনোর মতো-- যা শুনবে ঠিক তা-ই লিখবে, ঠিক তেমনি করেই লিখবে)৤ মুখে বলার রূপ বা ধ্বনি এবং উচ্চারণ দ্রুত পালটে যায়, কিন্তু লেখার একটি স্থায়ী বিশেষ দৃশ্য-রূপ থাকায়, লেখার দৃশ্যরূপটি ধ্বনি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই পালটানো কঠিন৤ তাই লেখ্যরূপ সব সময়েই উচ্চারিত রূপ থেকে পিছিয়ে থাকে৤ ভাষার উচ্চারিত রূপকে লিখনের মাধ্যমে যথাযথভাবে ধরতে না-পারাই হল ‘বানান সমস্যা’ ৤ এ সমস্যা সকল ‘লিখিত’ ভাষাতেই আছে৤ শ্রুতিভাষার কোনও ‘বানান সমস্যা’  নেই৤ তাতে অবশ্য উচ্চারণভেদ সমস্যা থাকতে পারে৤ সেটাও কম সমস্যা নয় মোটেই৤ 


        বাংলাদেশের লেখক শামসুল হক তাঁর ‘হরফ পেলাম কেমন করে’ বইয়ে বলেছেন-- “আমাদের ভাষায় আমরা ব্যবহার করি মাত্র গুটি কয়েক হরফ৤ সুমেরিয় ভাষায় হরফ ছিল তিন শ’ পঞ্চাশটি৤ অ আ ক খ এমনি ধরনের আলাদা আলাদা অক্ষর কিন্তু সেখানে কখনই সৃষ্টি হয়নি৤ অর্থাৎ সত্যিকারের হরফ হওয়ার গৌরব কিউনিফরম লিপি অর্জন করতে পারেনি” (পৃঃ ২৩)৤ 


          আমাদের বাংলা লিপি তথা বর্ণমালা কিন্তু পুরোপুরি একশভাগ বর্ণমালাক্রমিক বা এ্যালফাবেটিক নয়, বরং অনেকাংশে অক্ষরভিত্তিক বা সিলাবিক৤ 


         তিনি আরও বলেছেন-- “মিশরে লেখা শুরু হয়েছিল চিত্রলিপি দিয়ে৤ ওই চিত্রলিপির নাম হায়ারোগ্লিফিক লিপি৤ অর্থাৎ পবিত্র লিপি৤ মিশরিয়রা বহুদিন ধরে ওই চিত্রলিপি দিয়েই তাদের লেখার কাজ চালিয়েছিল৤ তবে চিত্রলিপি দিয়ে সবকিছু লেখা যেত না৤ আম, গাছ, মানুষ-- এসব জিনিস চোখে দেখা যায়৤ তাই চিত্রলিপি দিয়ে এগুলি এঁকে বোঝানোও সহজ৤ কিন্তু সাহস, বুদ্ধি, সপ্তাহ এগুলি চোখে দেখা যায় না৤ তাই চিত্রলিপি দিয়ে এগুলি প্রকাশ করা সহজ ছিল না৤ এসব জিনিস শুধু ধারণা করা যায়, ভাবা যায় তাই প্রাচীন কালের লোকেরা এইসব জিনিস প্রকাশের জন্যে কোন চিহ্ন ব্যবহার করেনি”(পৃঃ২৯-৩১), বা করতে পারেনি৤ তারা বিমূর্ত ধারণাকে ধরতে পারেনি৤ তাদের মেধার বিকাশ তখনও ঠিক সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি৤  

        দিন যায়, বছর যায়৤ ক্রমে (বিমূর্ত)ভাব প্রকাশের প্রয়োজনও দেখা দিল৤ মিশরিয়রা তাদের ভাবনাগুলো লিখতে চাইল৤ শেষে তারা ছবি এঁকেই ভাব প্রকাশের কায়দা উদ্ভাবন করল৤ নতুন এই লিপির নাম দেওয়া হয়েছে ভাবব্যঞ্জক লিপি৤ আজ থেকে প্রায় ছ’হাজার বছর আগে হায়ারোগ্লিফিক লিপির মধ্যে চিত্রলিপি(pictogram) ও ভাবলিপি(idiogram) দুই-ই ছিল৤ পরে এদের সাথে ধ্বনিচিহ্নও ব্যবহৃত হতে থাকে৤ অল্পদিনের মধ্যেই হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে ব্যঞ্জন ধ্বনিওয়ালা চব্বিশটি বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়েছিল৤ স্বরধ্বনিওয়ালা কোনও বর্ণ এই লিপিতে ছিল না৤ “বর্ণমালার ইতিহাসে স্বরবর্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল পরে৤ সে যাহোক, সত্যিকারের হরফ তৈরির গৌরব মিশরবাসীরা অর্জন করতে পারেনি৤”(পৃঃ ২৯-৩২)৤  

        আমাদের উদ্দেশ্য হবে, ভাষার উচ্চারিত রূপের সঙ্গে তার বর্তমান প্রচলিত ‘লিখিত’ রূপ-এর মধ্যে সমাপতন(Synchronization) ঘটানো৤ গানে-- বাজনার তালে এবং সুরে সম লয় না থাকলে, তা যেমন বে-সুরো বেখাপ্পা হয়, তেমনি ভাষায়-- বলা এবং লেখার মধ্যে ছন্দপতন ঘটে গিয়ে তা যাতে ‘বে-সুরো’ নাহয়, সেজন্য সতর্ক এবং সজাগ দৃষ্টি রাখাই হল ভাষা-সংস্কারের কাজ৤  বলার সঙ্গে বানানের মিল না ঘটলেই লেখায় ‘বে-সুর’ ফুটে ওঠে৤ ‘আত্তিয়’ উচ্চারণ করে “আত্মীয়”[আত্মীয়=আত্‌মীয়] লেখা মিথ্যাচার, তাতে আত্মীয়তা নষ্ট হয়! বলায় এবং লেখায় যত পার্থক্য ঘটবে মিথ্যাচার ততো বাড়বে৤ বাংলা বলা এবং বাংলা লেখা -র মধ্যে পার্থক্য তথা মিথ্যাচার দূর করাই হল বাংলাভাষা সংস্কারের উদ্দেশ্য৤ 


 ৬৫

        ধরি লেখা হল-- “মার্জারে(বিড়ালে) মৎস্য আহার করে, অলাবু(লাউ) ভক্ষণ করে না৤” কেউ যদি পড়ার সময়ে সেটাই পড়ে-- “মেকুরে মাছ খায়, কদু সাঁটায় না৤” তবে সেটা কেমন হবে৻ লেখা থাকবে এক রকম, আর সেটা আমরা পড়ব অন্য অনুবাদে, কিংবা বলাটা অনুবাদ করে লেখা হবে৤ এসব দিক-হারা ব্যবস্থার কোন দরকার আছে কি? আমরা সরাসরি লিখব৤ যা বলা হবে, লেখাও হবে হুবহু তাই-ই৤ ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘পথ হারানো পথিক’ হবার কোনও দরকার আছে কি? এক কালে লেখা তার ‘পথ হারায়নি’, পরে মুখের বলার সঙ্গে লেখা ছুটে ছুটে তাল রাখতে না-পেরে পথ হারিয়ে ফেলেছে৤ তবে সবটুকুপথই সে হারায়নি, যেটুকু হারিয়েছে, তা এবার আমাদের আপন উদ্যোগে ধরিয়ে দিতে হবে, আর সেটা আমাদেরই একান্ত আপন স্বার্থে৤ উচ্চারিত রূপ এবং লেখ্য রূপের মধ্যে এত পার্থক্য কি মানা হবে? “আত্তিয়” বলে কি তা আত্‌মীয়(=আত্মীয়) লেখা হবে? বলার উচ্চারণ এবং লেখার বানান যদি আলাদা হয়, তবে ভাষা তো দুটো  হয়ে গেল,তাতে অকারণ সময় এবং শক্তির ক্ষয় ঘটে৤ বাংলাভাষাকে তার নিজস্ব প্রেক্ষিতে  সংস্কার না করলে বাংলাভাষাকে বাঁচানো কঠিন হবে৤ 

        কিন্তু কূট প্রশ্ন তোলা হয় কোন্‌ ‘বলা’-কে লেখায় রূপ দিতে হবে, অর্থাৎ কোন্‌টা প্রমিত বাংলা-- মান্য ভাষা? পুবে অহমের শিলচর(কাছাড়) থেকে পশ্চিমে পুরুলিয়া, এবং দক্ষিণে, দক্ষিণ ২৪-পরগনা থেকে উত্তরে দার্জিলিং-- এর কোন্‌ অঞ্চলের কোন্‌টা মান্য রূপ? এটা অবশ্য বিতর্ক করার জন্যই প্রশ্ন তোলা৤ রেডিয়ো, টিভিতে যে বাংলা চলে, সংবাদপত্রে যে বাংলা চলে-- কোলকাতা এবং তার আশেপাশের বাংলা, তা-ই হল প্রমিত বাংলা৤ লেখায় সর্বত্র এই বাংলাকেই ধরতে হবে৤  

        বাংলাভাষার কতটুকু সংস্কার করতে হবে? যতটুকু হলে উচ্চারণে এবং লিখনে সমাপতন ঘটে৤ বাংলা বানান হবে ফোনিমিক বানান, অর্থাৎ বানান হবে উচ্চারণমূলক (ফোনিমিক phonemic), তা পুরো একশ’ ভাগ না হোক, ৯৫% শতাংশ হলেই চলবে৤ “উচ্চারণে ধ্বনির যে-পরিবর্তনগুলি আমাদের বোধে বিশেষ প্রকট  গ্রাহ্য-- শুধু সেগুলিকে বানানে দেখালেই হবে৤(পবিত্র সরকার, বাংলা বানান সংস্কার : সমস্যা ও সম্ভাবনা, পৃঃ-৩০)৤  পাঁচ ভাগ ছাড় দেওয়া হবে এই জন্য যে, পরিবর্তন সর্বদাই ঘটছে-- এবং ঘটে চলেছে, সে পরিবর্তন একটা নির্দিষ্ট অবয়বে না-পৌঁছানো অবধি তা লিখিত রূপের মধ্যে ধরার দরকার নেই৤ যেমন, জীবন, দরদ --শব্দদুটি জীবোন, দরোদ করে লেখা এবং বলা যায়, কিন্তু তা প্রকৃত পক্ষে একশ’ভাগ জীবোন, দরোদ নয়৤ কারণ এই পরিবর্তন অস্ফূট-- ভবিষ্যতে তা জীবোন, দরোদ হতে পারে, বা না-ও পারে৤  

        এখন অবধি যে-সকল প্রতিষ্ঠান বাংলা বানান সংস্কার করেছেন, সে-সংস্কারের সবটাই হল মৃদু সংস্কার৤ অর্থাৎ একটু ধুলো ঝাড়া, বা গা-মোছার মতো ব্যাপার৤ ডুব দিয়ে অবগাহন স্নান করে পরিশুদ্ধ হওয়া এখনও বাকি৤ সে কাজটা এবার করতে হবে, আর দেরি করা ঠিক নয়৤ কথায় বলে শুভস্য শীঘ্রম্‌-- শুভ কাজ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে হয়৤ ভাষা ও বানান সংস্কারে যত বেশি দেরি হবে ততোই তা বাংলাভাষার পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠবে৤  কারণ শিক্ষার প্রসার যত বেশি হবে, ততোই আরও বেশি বেশি লোকের প্রত্যেককে এই পরিবর্তনের খবরটা আলাদা করে পৌঁছে দিতে হবে, তাদেরও তখন সে পরিবর্তনটা করে নিতে হবে৤ বানান-সংস্কারের কাজটা আগে আগে করে নিলে নতুন শিক্ষার্থীরা নতুন ব্যবস্থাতেই শুরু করতে পারবে, নইলে পরে পরিবর্তনের ধাক্কায় পড়ে যাবে৤ আসুন আমরা এখুনি বাংলাভাষা সংস্কারে হাত দিই৤ কারণ বাংলা বানান-সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হয়েছে বহু বছর আগে৤ তার তেমন সুফল এখনও আমরা পাইনি৤ আসলে সেসব সংস্কার হল বাংলাভাষায় সংস্কৃত বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার সনিষ্ঠ উদ্যোগ৤ বাংলাভাষায় খাঁটি বাংলা বানান লেখার কোনও উদ্যোগ এখনও অবধি কার্যকর হয়নি৤ পুথির যুগে যে-বাংলা বানান লেখা হত, পরবর্তী কালে সংস্কৃত পণ্ডিতেরা এসে তাতে হস্তক্ষেপ করে তা ‘বিশুদ্ধ’ করার জন্য, এবং সেসব ক্রমে সংস্কৃতমুখী করে তোলেন৤ তাঁদের সদিচ্ছাই ছিল, কিন্তু তা বাংলাভাষার পক্ষে শেষ অবধি সুফলদায়ক হয়ে ওঠেনি৤ বাংলা বানান নিয়ে তাই আজ এত সমস্যার জট৤ 



 ৬৬

        “চৈতন্য সাহিত্য বাংলা ভাষার যে কেবল জীবন-চরিত লেখার প্রবর্তন করল, তা-ই নয়, ভাষার ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা বানানেও সর্বপ্রথম বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা করতে লাগল৤ এর প্রধান কারণ এই যে, চৈতন্য(১৪৮৫--১৫৩৩, জীবনকাল ৪৮ বছর) চরিতকারের সকলেই সংস্কৃত ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন৤ সেজন্য বিশুদ্ধ সংস্কৃতশব্দের ব্যাপক ব্যবহার ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাদের যত্ন ও চেষ্টা স্বাভাবিক৤ এভাবে ভারতচন্দ্র রায়ের (১৭১২--১৭৬০, জীবনকাল ৪৮ বছর) আবির্ভাবের পূর্বেই সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ ও সেগুলির বানানের বিশুদ্ধতা রক্ষার চেষ্টা বাংলাভাষায় বিশেষভাবে বিস্তৃতিলাভ করেছিল৤” (বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠসমীক্ষা-- মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, পৃঃ-৮৮, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৮৪ )৤ 

        এই যে তথাকথিত বানান-সংস্কার হচ্ছে, তার ফল কী দাঁড়াচ্ছে? এর ফলে বাংলা ভাষায় বাংলার চেয়ে সংস্কৃতের অধিকার যে বেশি-- এটা প্রমাণিত হচ্ছে, এবং তা আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে৤  ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, বাংলায় বানান লিখতে হলে সংস্কৃতের অনুমতি নিতে হবে! বলা হচ্ছে অন্যান্য ভাষার শব্দের বানান বাংলা-উচ্চারণ অনুযায়ী হবে-- কেবল সংস্কৃত শব্দের বানানে হাত দেওয়া যাবে না৤ সংস্কৃত শব্দের বানান যথাপূর্ব রাখতে হবে৤ অর্থাৎ অন্য ভাষার ‘জঞ্জাল’ সরিয়ে সংস্কৃতের উপর আলো ফেলে তার অধিকারকে এতে আরও জোরালো করা হচ্ছে!  

        এযুগে যাঁরা বাংলাভাষা সংস্কার করেছেন তাঁরা হলেন-- (১)বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯২৫, (২)কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৩৬-৭(বাংলা বানানের নিয়ম, তৃতীয় সংস্করণ অবধি), (৩)আনন্দবাজার পত্রিকা, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯১, (৪)বাংলা একাডেমী, ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৯২, (৫)পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯৭৤ 


         পাঁচটি উদ্যোগের চারটিই পশ্চিমবঙ্গের৤ লক্ষণীয় বাংলাদেশে বাংলা বানান সংস্কার একমুখী বা একক, বিবিধ মতের মতান্তর সেখানে নেই৤ তবে সকল উদ্যোগের মূল সুর হল, বাংলা বানানকে সংস্কৃত বানানের অনুসারী করতে হবে৤ যে-সকল সংস্কৃত শব্দ বাংলায় নেওয়া হয়েছে, সেসবের বানান আবশ্যিকভাবে সংস্কৃত করেই রাখতে হবে, অন্যথা করা যাবে না৤ এ ঋণ শর্তাধীন, কারণ ধরে নেওয়া হয় যে, সংস্কৃত হল বাংলাভাষার জননী৤ 


         কিন্তু সংস্কৃতাচার্য মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়(১৮৫১-১৯৩১, জীবনকাল ৮০ বছর) সংস্কৃতভাষাকে বাংলাভাষার জননী বলে মনে করতেন না৤ তিনি বলেছেন-- “অনেকের সংস্কার বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা৤... ... আমি কিন্তু সংস্কৃতকে বাংলার অতি..অতি..অতি ..অতি..অতি..অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহী বলি৤ পাণিনির সময়ে সংস্কৃতকে ভাষা বলিত অর্থাৎ পাণিনি যে সময়ে ব্যাকরণ লেখেন, তখন তাঁহার দেশের লোকে সংস্কৃত কথা বার্তা কহিত৤ তাঁহার সময়ে আর-এক ভাষা ছিল, তাহার নাম ‘ছন্দস্‌’-- অর্থাৎ বেদের ভাষা৤ বেদের ভাষাটা তখন পুরানো, প্রায় উঠিয়া গিয়াছে৤ সংস্কৃত ভাষা চলিতেছে৤ পাণিনি কত দিনের লোক তাহা জানিনা, তবে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ, সপ্তম শতকের বোধ হয়৤” পাণিনির সময়ে সংস্কৃত এবং তার আগের উপনিষদীয় সংস্কৃত তথা প্রত্ন-সংস্কৃত, এবং তারও আগের বৈদিক-ভাষা, যার নাম ছিল ‘ছন্দস্‌’ সেখান থেকে আলোচনার সূত্র ধরে আধুনিক বাংলা অবধি আলোচনা করে তিনি তাঁর মন্তব্যের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন৤ তিনি বলেছেন, “সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক অনেক দূর৤” (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২য় খণ্ড, ১৯৮১, পৃঃ-৩৬৭)৤ 



 ৬৭


        বাংলায় শব্দের স্তর তিনটি৤ শিশুদের যখন প্রথমে শব্দ শেখানো হয়, তখন শুরুতে শেখানো হয় হাত পা চোখ কান নাক দাঁত মাথা চুল পেট জিভ ইত্যাদি৤ এই স্তরে তাদের স্নেহ, উদারতা ইত্যাদি শব্দ শেখানো যাবে না, কারণ এই  শব্দগুলোর অর্থ তারা বুঝবে না, যেহেতু এগুলো হল ভাববাচক বা ভাবপ্রকাশক বিমূর্ত  শব্দ৤ আর হাত পা চোখ কান নাক ইত্যাদি হল মূর্ত  শব্দ৤ এই বস্তুগুলো ধরা ছোঁয়া যায়, বোঝা যায়৤ এর মাঝামাঝি  শব্দ হল বাবা দাদা কাকা মামা দিদি পিসি ননদ ভাজ তালুই বেয়ান, খালা ফুফা চাচা আন্টি মানা ফাদার/ড্যাড ব্রাদার সিস্টার ইত্যাদি৤ এগুলি অর্ধমূর্ত শব্দ৤  শব্দের থাকে এই তিনটি স্তর৤ সব ভাষাতেই  শব্দের এই রকম তিনটি স্তর থাকে৤ (১)মূর্ত শব্দ, (২)অর্ধমূর্ত শব্দ, এবং (৩)বিমূর্ত শব্দ৤ 

        যেভাষায় বিমূর্ত শব্দের সংখ্যা যত বেশি সে ভাষা ততো উন্নত৤ সুললিত বিমূর্ত শব্দ তো বাংলায় আছেই, বাংলায় সুলিত বিমূর্ত বাক্য ব্যবহারও অনেক আছে৤ বিশেষ করে কবিতায়৤ যেমন-- একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ..., কিংবা,  চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা৤ কিংবা দেখি বাক্যবিভা “বুঝি সেদিনও সজনি এমনি রজনী আঁধিয়ার...”, কিংবা বৈষ্ণব পদ-- লোল কুণ্ডল দীপতি মণ্ডল, উয়ল যুগল গণ্ড...৤ রবীন্দ্র গদ্যেও সুললিত বিমূর্ত বাক্যের প্রচুর প্রয়োগ আছে৤ বাক্য ব্যবহারের কারিকুরিতে মনে হবে খুব সহজ, অনায়াসগম্য, কিন্তু অর্থের তল পাওয়া কঠিন৤  

        অন্য অনেক লেখকের রচনায়ও বিমূর্ত শব্দ বাক্য ব্যবহারের অঢেল উদাহরণ পাওয়া যাবে৤ যেমন-- ‘তোমার প্রাণপ্রিয় চিকুরতনয়ের প্রাণ হতে তোমার প্রাণের গভীরে নব প্রাণ আহ্বান কর মাতলিতনয়া৤’ ললিত বিমূর্ত বাক্য ব্যবহারের জন্য বাংলাভাষা-- ভাব প্রকাশে এত দক্ষ, এবং এত অগ্রগত৤ 

        একটু আগেই বলা হয়েছে, “মিশরে লেখা শুরু হয়েছিল চিত্রলিপি দিয়ে৤ ওই চিত্রলিপির নাম হায়ারোগ্লিফিক লিপি৤ অর্থাৎ পবিত্র লিপি৤ মিশরিয়রা বহুদিন ধরে ওই চিত্রলিপি দিয়েই তাদের লেখার কাজ চালিয়েছিল৤ তবে চিত্রলিপি দিয়ে সবকিছু লেখা যেত না৤ আম, গাছ, মানুষ-- এসব জিনিস চোখে দেখা যায়৤ তাই চিত্রলিপি দিয়ে এগুলি এঁকে বোঝানোও সহজ৤ কিন্তু সাহস, বুদ্ধি, সপ্তাহ এগুলি চোখে দেখা যায় না৤ তাই চিত্রলিপি দিয়ে এগুলি প্রকাশ করা সহজ ছিল না৤ এসব জিনিস শুধু ধারণা করা যায়, ভাবা যায় তাই প্রাচীন কালের লোকেরা এইসব জিনিস প্রকাশের জন্যে কোন চিহ্ন ব্যবহার করেনি”(হরফ পেলাম কেমন করে, শামসুল হক, পৃঃ২৯-৩১)৤ 

        একটা জিনিস লক্ষ করার যে, প্রথমে মানুষ লেখার চেষ্টা করল দূরের কোনও লোককে তার নিজের কথা পৌঁছে দেবার জন্য, অথবা সামনে অনুপস্থিত কারও জন্য, অথবা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য৤ এখনও লেখার উদ্দেশ্য তা-ই আছে৤ যখন মানুষ লিখতে পারল সে হল এক বিশাল আশ্চর্য উদ্ভাবন৤ অতীতের মানুষ কেন, সব যুগেই মানুষ চেষ্টা করে নতুন নতুন পথ পদ্ধতি বের করে মানুষের জীবন-জীবিকাকে সহজ সুন্দর অনায়াস করতে৤ সে প্রয়াস তো থেমে নেই বা থেমে যায়নি, পৃথিবীর সব দেশের মানুষ সে চেষ্টা করেছে এবং করে যাচ্ছে৤ সুতরাং আমরা বাংলাভাষার বানান, লিপি, লিখন-পদ্ধতি, হরফ-গঠন ইত্যাদি নিয়ে আমাদের প্রয়াস চালিয়ে যাব৤ সায়ন্তন বা আব্বাস বা বুদ্ধাইরাম বা পিটার কেউ না কেউ একদিন সফল হবে৤ মানব সভ্যতা তো কারও একার চেষ্টায় এগোয়নি, এগিয়েছে বহু লোকের বহু চেষ্টা, বহু ব্যর্থতার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে, এবং পরবর্তী প্রয়াসের সাফল্যের উপর নির্ভর করে৤ আর এভাবেই মানব সভ্যতা আজ এখানে এসে পৌঁছেছে৤ আর অবশ্যই তা এখানেই থেমে থাকবে না, ক্রমেই এগোবে, ক্রমেই পরিবর্তিত হবে৤ 




 ৬৮

        বাংলায় যেমন শব্দের তিনটি স্তর, তেমনি বাংলা বলার স্তরও তিনটি-- (১) মেঠো গ্রাম্য বাংলা, (২)শহুরে শিষ্ট বাংলা, এবং (৩)তথাকথিত হাই-সোসাইটির এ্যাংলিয়ান বাংলা (Anglomania সঞ্জাত উন্নাসিকতা-দুষ্ট)৤ 

        গ্রাম্য পরিবেশে কথাবার্তা একদম সাদামাটা  সোজাসাপটা করে বলা হয়, শহুরে পরিবেশে কথাবার্তা বেশ গুছিয়ে শিষ্ট মার্জিত করে বলা হয়, আর উন্নাসিক এ্যাংলিয়ান পরিবেশে বাংলা বলা হয় ইংরেজি কায়দায়, যেন তা খানিকটা করুণা করে বাংলা বলা, ভাবখানা এই যে, বাংলাটা তেমন আসেনা, নেহাত কোনও এক বাঙালির সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে বলেই বাংলা বলা, কিংবা বাংলা বলাটা যেন এক কৌতুকের ব্যাপার! আমি যে আর দশটা পাতি বাঙালির মতো ওঁছা নই সেটা বুঝিয়ে ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা৤ আধো আধো বুলিতে মনে কি কৌতুক জাগে যে, এদের মুখে গুঁজে দেওয়া হোক শৈশবের সেই দুধের মাইপোশ! টিভিতে তরুণীদের মুখে এর বেশ অঢেল অকৃপণ ছড়াছড়ি৤ এসব গ্রাম্য, শহুরে বা এ্যাংলিয়ান পরিবেশে গেলেই এমনি বাংলা বলা শোনা যাবে৤ এই তিনটি স্পষ্ট বিভাগের মাঝামাঝি আরও দুটি উপবিভাগ আছে-- আধা শহুরে, এবং আধা এ্যাংলিয়ান৤ 

        বাংলা বানান সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ক যাবতীয় যা-কিছু চিন্তাভাবনা তা সবই শহুরে শিষ্ট প্রমিত বাংলা নিয়ে৤ এই শহুরে শিষ্ট বাংলাতেই আমাদের যাবতীয় সাহিত্য-- গল্প কবিতা উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ রম্যরচনা ইত্যাদি, এবং বিজ্ঞান অঙ্ক ভূগোল ইতিহাস বাণিজ্য সমাজ-বিদ্যা ইত্যাদি যাবতীয় যা কিছু সবই রচিত৤ অবশ্য লোকজীবনের লোকসংগীতের ভাষা গ্রাম্য বাংলায়, তা যে গ্রাম্য মানুষেরা গ্রাম্য মানুষের কথা ভেবে রচনা করেছেন৤ 


        সংবাদপত্রে লেখা, বা রেডিয়ো টিভিতে খবর পড়া হয় শহুরে শিষ্ট বাংলাতেই৤ এটিই শিষ্ট প্রমিত(standard) বাংলা৤ এই বাংলারই বানান সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে৤ চিন্তা ভাবনার ব্যাপারটা শহুরে শিষ্ট প্রমিত বাংলা নিয়ে হলেও, বাংলা বানান সংস্কারের ব্যাপারটা কিন্তু কোনও বুদ্ধির লড়াই নয়, জ্ঞানের লড়াই নয়, ইগোর লড়াই নয়-- বরং শহর গ্রাম সুদূর সুন্দরবন বা বিচ্ছিন্ন আন্দামান বা নিবিড় দণ্ডকবন, বা ঝাড়খণ্ডের অরণ্য-প্রান্তর কিংবা কাছাড়-শিলচর-বরাকের অথবা ত্রিপুরার উপত্যকা-- সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় বাংলাভাষাকে সহজ সরল অনায়াস এবং সুন্দর করে তোলার উদ্যোগ এটি৤ তাই সবার একান্ত সনিষ্ঠ আন্তরিক সহযোগ এখানে প্রয়োজন৤ 

        ভাষার মধ্যে আছে আবহাওয়ার প্রবল প্রভাব৤ গরমের দেশে গরমকে ভয়, আর শীতের দেশে শীতকে ভয়-- ভাষার মধ্যেও তার ছোঁয়া দেখা যায়৤ যেমন গ্রীষ্মপ্রধান আমাদের দেশে লোকের কথা শুনে ‘প্রাণ জুড়িয়ে যায়’, কিন্তু শীতের দেশে ‘throw cold water on a proposal’, আবার সেখানে লোকে পায় ‘worm reception’, আমাদের ভাষায় আক্ষরিক অনুবাদে সেটাই হয়েছে ‘উষ্ণ অভিনন্দন’৤ ও-দেশের নিয়ত খারাপ আবহাওয়ায় ‘morning shows the day’, আমাদের দেশে ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়৤ এদেশে যেমন গরমে লোকের প্রাণ আইঢাই করে, আর ওদেশে শীতের মধ্যে একটু উষ্ণতার জন্য কী আকুলি বিকুলি৤ তারই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ চিহ্ন দেখি ভাষা ব্যবহারে, worm reception কথায়৤ আমাদের দেশে আছে বর্ষামঙ্গল সঙ্গীতালেখ্য, কৃষিভিত্তিক দেশে যা উর্বরতার আবাহন৤ ওদেশে ঝড়বৃষ্টি প্রবল তুষারপাত কিন্তু মানুষের জীবনযন্ত্রণার নিয়ত বিলাপের বিষয়৤ (আবহাওয়া বিষয়ের এই ভাবনাটি দেখা যাবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের একটি রচনায়, এখানে তার ভাব অনুসরণ করা হয়েছে)৤ 


         ভাষায় আছে নানা সমাজচিত্রও-- গাঁটের পয়সা(তখন জামা ছিল না, তাই পকেটও ছিল না), টাকা-কড়ি(কড়ি দিয়েও কেনা-বেচা চলত, তারও বাজার-দর ছিল), গাড়ি-ঘোড়া, লোক-লস্কর, লাল পয়সা(তামার পয়সা) ইত্যাদি৤   



 ৬৯

        ভাষা কী? স্বরযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত বিশেষ ধ্বনি ও শব্দ প্রবাহের দ্বারা, সাধারণভাবে একটি ভৌগোলিক সীমায় অবস্থিত, গোষ্ঠীবদ্ধ একদল মানুষের মনের ইচ্ছা ও ভাব প্রকাশের ব্যবস্থা হল ভাষা৤ 

        মাতৃভাষা কী? যে-ভাষায় মানুষ তার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করে, স্বপ্ন দেখে, স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে সেটাই তার মাতৃভাষা৤ 

        বানান কী? মুখের উচ্চারিত অর্থবহ শব্দ ও ধ্বনি প্রবাহকে লিখনের মাধ্যমে ধরে রাখার সুসংবদ্ধ লিপি-ব্যবস্থা হল বানান৤ 

        শহরের লোকের ইটের পাকা বাড়ি, গ্রামের লোকের মাটির কাঁচা বাড়ি৤ কিন্তু মূলগত তফাত কিছু নেই-- মাটিকে পুড়িয়ে পাকা ইট, পাকা বাড়ি৤ অর্থাৎ ইংরেজি বিশাল এবং শক্তিমান ভাষা, বাংলা হয়তো-বা তার চেয়ে একটু দুর্বলই এবং আটপৌরে ঘরোয়া ভাষা, তা হতে পারে কিন্তু বাংলার মধ্যে নিহিত যে শক্তি, প্রাণসম্পদ আছে তাকে ছেনে ঘেঁটে শ্রম ও অধ্যাবসায়ে গড়ে তোলা যাবে বিশাল পরিসরের এক সুন্দর সহজ সরল নবীন জীবিকার ভাষাকে--সুদৃঢ় ইটে সুনির্মিত উজ্জ্বল আধুনিক নগর নিকেতন৤ এজন্য চাই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, কঠোর অনুশীলন, ও অধ্যাবসায়ের, অ-নমনীয় প্রতিজ্ঞার৤ চাই-- “করবই” এই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজে নেমে পড়া৤ 

         এককালে ইংরেজিও ছিল গেঁয়ো আটপৌরে ভাষা৤ অবহেলিত ভাষা৤ সে ভাষার এই বিশ্বপ্রসারী উত্থান এমনিতে হয়নি, তার পিছনে অনেক অনেক প্রয়াস নিয়োগ করতে হয়েছে৤ ইংরেজির বিশ্বপ্রসার হয়তো তাদের সাম্রাজ্যবাদী কাজের জন্য হয়েছে, কিন্তু তার সমৃদ্ধি আপনিই ঘটেনি৤ 

        কোন একটি ভাষার শক্তির মূল উৎস তার রাষ্ট্রনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ, রাজনৈতিক মদত ও পৃষ্ঠপোষণ৤ বাংলাভাষার প্রকাশ ক্ষমতার বৈভব খুব জোরালো এবং সুউচ্চ৤ তা বিশ্বমানের তথা আন্তর্জাতিক মানের হলেও বাংলাভাষা কোনও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ পায় না বলে তার মহিমা এদেশে(ভারতে) তেমন কীর্তিত হয় না৤ বিশ্বের শ্রেষ্ঠভাষা ক’টির একটি হল বাংলা, তা যেমন জনসংখ্যায় তেমনি তা গুণমানে৤ শ্রুতি মাধুর্যে তা প্রথম সারিতে, শৈলীর বৈভবে তার অবস্থান শীর্ষভাগে, প্রকাশ-পারঙ্গমতায় তা অতুল অমিয়৤ 

        রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রপ্তির বিষয়ে উল্লেখ করে জে.ডি. এন্ডারসন, ডি.লিট, আই সি এস, বঙ্গীয় তথা ঢাকা সাহিত্য-পরিষদের সদস্য, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষার অধ্যাপক ১৯২০-তে বলেছেন--'সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও মাধুর্যের বিচারে এ এক বিলম্বিত ... স্বীকৃতি৤... মানবিকতা, কারুণ্য ও সরসতাগুণে এ-সাহিত্যের গরিমার কথা মানতেই হয়, মানতে হয় এর লক্ষণীয় বৈচিত্র, নম্য রীতিকলা এবং গদ্য-পদ্য নির্বিশেষে প্রকাশশৈলীর বহুমুখী ঐশ্বর্য ...৤ পাশ্চাত্য সাহিত্যর অনুবাদ-বাহন হিসেবেও সমস্ত ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতা অবশ্যস্বীকার্য৤' (উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ফরাসিভাষা-ভাষী অতুলনীয় বাংলা লেখক ফাদার দ্যতিয়েনের বাংলায় লিখিত 'ডায়েরির ছেঁড়াপাতা' থেকে, পৃঃ-২৪) এখানে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের অপার মাধুর্য লক্ষ করুন৤ ফাদার দ্যতিয়েন বলেছেন, “বাংলা ভাষার ধ্বনিমাধুর্য, সংগীত আমায় আকৃষ্ট করেছে৤ বাংলা গদ্যের সুরের মূর্ছনা আমার কানে বাজে৤” (বইয়ের দেশ, জানুয়ারি-মার্চ ২০১০,পৃঃ-১১৯)৤ 




 ৭০


        খ্যাত জাপানি 'বাংলাভাষী' কাজুও আজুমা বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাকক্ষে, ৩০-১২-১৯৯৯ তারিখে বলেছেন, "আমি পৃথিবীর কয়েকটি ভাষা শিখেছি৤ বাংলাভাষা সবচেয়ে সুন্দর ও মধুর মনে করি৤ বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি, বাংলাভাষা তার ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত ভাষা৤" (তাঁর বাংলা বলা প্রায় বাঙালির উচ্চারণে, বিদেশির মতো নয়) 

     বাংলাভাষার জাপানি শিক্ষক কিওকা নিয়োয়া বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে(৩০-১২-১৯৯৯) বলেছেন__'একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি হিন্দি এবং বাংলা পড়াই৤... রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রম নন'(অর্থাৎ এমন কবি সাহিত্যিক বাংলায় আরও আছেন)৤ 

     'প্রগতি প্রকাশন' মস্কো-এর বাংলা বিভাগের প্রধান রাইসা ভালুয়েভা বলেছেন (১৯৭৫)__ "আমার ধারণা যে বাংলাভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সুরেলা ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম৤" (‘সোভিয়েত নারী’ পত্রিকা)

     "আমি বাংলাভাষার প্রেমে পড়েছি৤ ভাষাটি কী সুন্দর কী মিষ্টি৤... বাংলা ভাষার সুর, উচ্চারণ, ছন্দ, তাল আমার কাছে খাঁটি মজা, ফুর্তি, আনন্দ"__ হানা টম্পসন৤[ইংরেজ মহিলা] ‘এরই মাঝে বাংলার প্রাণ’ দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬৤ বই সংখ্যা, পৃঃ ১২৯৤  

     রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক চিনা অধ্যাপক দং ইউ চেন জানিয়েছেন “বাংলাভাষাকে আমার গান মনে হয়৤ আর, গানে ডুবে গেলে ভেসে ওঠার উপায় নেই৤ গানের টান খুব গভীর৤” (আজকাল, সংস্কৃতি, ২২/০৫/২০১০, শনিবার, পৃঃ-২)৤ 

        “বাংলাভাষী” কে.জি. সুব্রমনিয়ন ‘দেশ’ সাহিত্যপত্র লিখেছেন--‘বাংলা ভাষা আবেগপ্রধান ভাষা’(৯মে, ১৯৮৭, পৃঃ ৪৩)৤ 

     চারুচন্দ্র ত্রিপাঠি (হিন্দি বিশ্বকোষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৤ বাংলা বিশ্বকোষ তৈরির সেমিনারে[৩১-১০-১৯৮৭] হিন্দিতে ভাষণ দেন৤ হিন্দিভাষী কিন্তু বাংলা বোঝেন), বলেন__ "এই দেশের সমৃদ্ধতম ভাষা বাংলা৤"  

     আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়(তাঁর নিজের মাতৃভাষা অবশ্য বাংলা) বলেন--“বাঙ্গলাকে নিসংকোচে একটি অতি সুন্দর ও শক্তিশালী ভাষা বলা যায়৤ ভারতীয় বা বিদেশীয় অন্য কোনও ভাষাকে উপেক্ষা করিয়া বা তাহার অমর্যাদা করিয়া বলিতেছি না৤ বাঙ্গলার শক্তি ও সৌন্দর্যের বিচার করিয়া একজন ইংরেজ বলিয়াছিলেন, ইতালিয় ভাষার মাধুর্য আর গ্রিক ভাষার শব্দ-গঠন-শক্তি, এ-দুই-ই বাংলা ভাষায় বিদ্যমান৤ আধুনিক সাহিত্যের কথা ধরিলে, বাঙ্গলার বিশেষ মহত্ত্ব স্বীকার করিতে হয়৤ বাঙলা ভাষার অনুরাগী আর একজন ইংরেজ বলিয়াছিলেন, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সাহিত্য-গৌরবে দুইটি প্রথম শ্রেণির ভাষা আছে__ একটি ইংরেজি, অন্যটি বাংলা৤ বাঙ্গলা সাহিত্য, প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালির এবং পরোক্ষভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মনকে আধুনিক জগতের চিন্তাধারার উপযোগী করিতে সাহায্য করিয়াছে৤” (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে, জিজ্ঞাসা, কোলকাতা, ১৯৭৫, পৃঃ-১২৬)৤ [ ব্যক্তিগত কথা বলি-- বইখানি প্রকাশের পর প্রথম কপি আমিই সংগ্রহ করি৤ ]



        ইংরেজ, ফরাসি, রুশ, জাপানি, চিনা, এবং ভারতের হিন্দিভাষী ও দক্ষিণভারতীয়রা বাংলাভাষা সম্পর্কে পঞ্চমুখ হলেও বাংলাভাষাকে বিহিত-সংস্কার করে সহজ সরল অনায়াস করে সামনের সারিতে ধরে রাখার আমাদের তেমন সনিষ্ঠ উদ্যোগ কোথায়? 

        যে-ক’টি ভাষা পৃথিবীতে বহুল প্রচারিত এবং প্রধান ভাষা বলে পরিচিত, সেগুলির দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, সেগুলির প্রায় সকলই প্রসারিত হয়েছে সাম্রাজ্যের সূত্রে৤ কিছু তার বাণিজ্যের সূত্রে৤ বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির জোরে এতটা প্রচারিত এবং প্রসারিত৤ বাংলাভাষা কিন্তু এসূত্রে প্রসারিত হয়নি৤ বাংলাভাষা কেবল তার আপন প্রাণশক্তির বলে জেগে উঠেছে৤ বাংলাভাষার মহত্ত্ব প্রচারের জন্য অন্য ভাষার মতো করে রাষ্ট্রীয় পেশিশক্তির জোরে বাংলাভাষাকে গিলিয়ে দিতে হয়নি বলে বাংলাভাষার প্রাণশক্তি কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে গেছে৤ বাংলাভাষা যেখানে সদ্য রাষ্ট্রীয় সমর্থন পেয়েছে সেখানে তাই সোনা ফলেছে--সেটি হল বাংলাদেশ৤ 

      এনসাইক্লোপিডিয়াতে বলা হয়েছে, সংস্কৃত হল Perfect language for all time, সম্প্রতি সংবাদপত্রে একটি খবর প্রচারিত হয়েছিল তাতে বলা হয়েছে,  ...is to be believed, Bengali has been voted the sweetest language in the world.(Times of India, Apr 22, 2010,) 






 ৭১

        ইংরেজি ভাষা “ইংরেজি” হয়েছে-- অর্থাৎ উন্নত ও আন্তর্জাতিক হয়েছে ইংরেজদের প্রাচীন ল্যাটিন ঝোঁক ত্যাগ করার পরে৤ তার আগে ইংরেজি ছিল সাধারণ অনাদৃত গাঁইয়া ভাষা৤ ‘দি নিউ ক্যাক্সটন এনসাইক্লোপিডিয়া’তে বলা হয়েছে[বাংলায় সরল অনুবাদে] __“অষ্টাদশ শতকে সরল সাধারণ ইংরেজিতে লেখার ব্যাপারটা ছিল আটপৌরে ঘরোয়া ব্যাপার৤ যেন পরচুলো না-পরে নিজস্ব চুলেই সাজগোজ করা[সে যুগে পরচুলা ছিল অভিজাতদের নিয়মিত পোষাকের অঙ্গ]৤ ঊনবিংশ শতকে দেশি-ইংরেজি শব্দ জনপ্রিয়তা ফিরে পেল, তবে তা সংগ্রাম না-করে হয়নি৤”(সংস্করণ- ১৯৭৯, খণ্ড-৭, পৃঃ-২৬৪)৤ 


        বাংলায় তো সেই সংগ্রামের যুগটাই চলছে৤ ইংরেজিতে সংগ্রাম হয়েছে ঊনবিংশ শতকে, বাংলায় হচ্ছে বিংশ শতকের শেষ ও একবিংশ শতকের শুরুতে৤ এ লড়াইয়ে জয়ী হতেই হবে, তবেই বাংলাভাষা সর্বত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রচার পাবে৤ বাংলা হয়ে উঠবে জীবিকার ভাষা৤ বাংলা হয়ে উঠবে বাণিজ্যের ভাষা, বিনোদনের ভাষা, জীবনের ভাষা৤ বাংলা হয়ে উঠবে হৃদয়ের ভাষা, বুকের ভাষা৤ ভাষাই তো জীবন-জীবিকার মূল হাতিয়ার(অবশ্যই সেটা রাষ্ট্রনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ সাপেক্ষ)৤ 

        এখানে একটা কথা বলা দরকার যে-- দখলদার ভাষা সব সময়েই শ্রেষ্ঠ ভাষা বলে গণ্য হয়, গণ্য করানো হয়৤ তার মান যা-ই হোকনা কেন সেটা তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়৤ তাতে ব্যাকরণগত লিঙ্গবোধ বা বিশেষণ বোধ না-ই থাক তাতে কি এসে যায়! পৃথিবীর যেক’টি ভাষাকে আমরা জোরালো ভাষা বলে জানি, তার সবগুলিই কমবেশি কোন-না-কোনও সময়ে দখলদার ভাষা ছিল৤ ইতিহাস তার সাক্ষী৤ বর্তমানও তার সাক্ষী৤ একটু খোলা চোখে তাকালে তার নজির দেখা যাবে৤ এই দখলদারি এযুগে আর সামরিক বল দিয়ে করা হয় না, করা হয় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক দখলদারির মাধ্যমে, মাথায় হাত বুলিয়ে, সুকৌশলে৤ 

        মুখের ভাষার পরিবর্তনকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, ঠেকিয়ে রাখতে চাইবেও না৤ ভাষা-সমুদ্রের স্রোত ঠেকানো যায় না৤ সেখানে বেত অচল, কিন্তু লেখার ভাষায়? সেখানে বানানে সর্বদা বেত উঁচু! মুখের বলাটা যদি বিশৃঙ্খলা না হয়, তবে বলা সেই উচ্চারণ মেনে যথাযথ লেখাটাও বিশৃঙ্খলা হবে না৤ ব্যাকরণ-শৃঙ্খলা তো ভাষার এক গভীর অন্তর্নিহিত ব্যাপার-- নিরক্ষর মানুষ কি ভাষা বলেন না? 


         মুখের বলাটাই তো ভাষা,  আর সেই ভাষাকেই অনুসরণ করবে লেখা, সেই ভাষাকেই অনুসরণ করবে ব্যাকরণ৤ বাংলাভাষার অতুলনীয় লেখক ফরাসিভাষী ফাদার দ্যতিয়েন কথা প্রসঙ্গে কৌতুক করে লিখেছেন, “বাঙালিরা বুঝলাম বলে এক আর লেখে আর এক৤” খাঁটি বাংলা লিখিত-ব্যাকরণ এখনও তৈরিই হয়নি! কিন্তু ব্যাপারটাকে প্রথাগত(অর্থাৎ সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারী) করে দিয়ে এক শ্রেণির পণ্ডিত সবকিছু ঠিক উলটো স্রোতে বইয়ে দিয়েছেন৤ বাংলাভাষার যে রীতি প্রকৃতি গতি তাকে ব্যাখ্যা করাই তো বাংলা ব্যাকরণের কাজ, অন্যেরা সেটা শিখে বাংলা রপ্ত করবে৤ তা না হয়ে বরং উলটো হচ্ছে, ব্যাকরণ(যেটা বাংলা ব্যকরণ নয়, সেটা সংস্কৃত ব্যাকরণ, যার মধ্যে আছে ইংরেজি ব্যাকরণের ছায়াও) অনুযায়ী বাংলাভাষা লেখার বিধান! এ যেন ভূমির ঢাল অনুসারে জল বয়ে যাবে না, জল অনুযায়ী ভূমিঢাল হবে!  


 ৭২

       আমাদের মতো ছা-পোষা গোবেচারা লোকদের দিয়ে পণ্ডিতেরা বাংলা বানানেও সংস্কৃত বানানের বর্ণময় কারিকুরি করাতে চাইছেন, আমাদের এলেমে তা ঠিক হয়ে উঠছে না, বরং তা আমাদের কাছে বোঝা হয়ে উঠছে৤ আমরা মুখ থুবড়ে পড়ছি৤ আমরা বেঘোরে চোখে লিপস্টিক লাগাচ্ছি, আর মাথায় আলতা পড়ছি, ঠোঁটে লাগাচ্ছি কাজল৤ 


           সংস্কৃত জানা পণ্ডিতেরা তাঁদের নিজেদের সু-উচ্চ মানকে সবার উপরে প্রয়োগ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের উপরে বানান এবং ব্যাকরণের বোঝা চাপিয়ে রেখেছেন৤ বরং যেটা করা জরুরি ছিল সেই লিখন এবং ব্যাকরণকে-- ভাষার স্রোত ধরে কিন্তু পথ হাঁটাচ্ছেন না৤ সাপ যেমন মাঝে মাঝে খোলস ছেড়ে নবকলেবর ধারণ করে, নদী তার কূল ভেঙে বয়ে চলে, ভাষাও প্রায় তেমনি করে প্রতি মুহূর্তে নবকলেবর ধারণ করছে৤ যদিও নদীখাতে পলি জমে জমে তা বড় রকমের পরিবর্তন (দ্বীপভূমি) সূচিত না করা অবধি আমাদের চোখে সেসব ধরা পড়ে না৤ ভাষার খোলস হল তার বানান এবং ব্যাকরণ৤ পরিত্যক্ত খোলস যেমন সাপকে আর ফিরে পরানো যায় না, তেমনি ভাষাকেও তার ছেড়েফেলা খোলস ফিরে পরানো যায় না৤ পণ্ডিতেরা যদিও ঠিক সেই উলটো চেষ্টাটাই করেন এবং মানুষের কষ্টের কারণ হন(আমাদের মতো অতি সাধারণ লোকের অতখানি ভজকট করার ক্ষমতা বা দক্ষতা কোথায়?)৤ 

        সংস্কৃত ভাষার অসীম সম্পদ এবং শব্দগঠনের অপরিমেয় ক্ষমতাকে আমরা কাজে লাগাব৤ শব্দের যা উচ্চারণ সেই অনুযায়ী বাংলায় সেশব্দের বানান লিখব৤ তাকে কেবল অন্ধ অনুকরণ করে বাংলাভাষাকে পঙ্গু করে রাখব না৤ তা করলে বাংলাভাষা হাস্যকর হয়ে উঠবে৤ বাংলাভাষাকে এর নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কার না করলে একে বাঁচানো কঠিন হবে৤ প্রবল বিরোধী চাপে, এবং শত উৎপাতে ভাষার তরু যে ঢলে পড়ার লক্ষণ-আক্রান্ত হয়েছে সেটা একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে৤ এই সময়ে-- অন্য ভাষার চাপ প্রতিরোধ করতে, এবং প্রযুক্তির প্রয়োজনে বাংলাভাষাকে সহজ সরল অনায়াস করতে হবে৤ ই-মেল(e-Mail), এসএমএস(SMS) আজও বাংলায় করা কঠিনই৤ 


        প্রযুক্তির প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না, ছাপাখানা তার বড় উদাহরণ, যার হাত ধরে শিক্ষার আজ এত ব্যাপক প্রসার ঘটেছে৤ অবশ্য অতিসম্প্রতি বাংলাভাষার যেটুকু কারিগরি অগ্রগতি হয়েছে তাতে বাংলায় ই-মেল করা যায়৤ ওয়েবসাইট ও ব্লগ তৈরি করা যায়, বাংলায় ওয়েব সার্চ করা যায়, এবং করা যায় আরও অনেক কিছু৤ বাংলাভাষার এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানাই, সঙ্গে সঙ্গে চাই আরও নিবিড় অনুশীলন ও অগ্রগতির জন্য বাংলাভাষার প্রকরণকে সরলতর করা৤ 


        বানান সংস্কারের ফলে দুটি শব্দের বানান একই হয়ে গিয়ে অর্থ-ভ্রান্তি হবে-- এটাই বানান সংস্কারের সবচেয়ে বড় বাধা বা অসুবিধা৤ সে অসুবিধাকে আমল না দিয়ে জবরদস্তি করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ঠিক কাজ হবে না৤ বরং সবাইকে বুঝতে হবে-- এই যে কষ্ট, অর্থাৎ মনোযোগ এবং শ্রম নিয়োগ, তথা Investment করা হচ্ছে, তা প্রাপ্ত সুফলের চেয়ে কম, নাকি বেশি? বেশি লাভ হলে সে কাজ বা ব্যবসায়েই মানুষ নামবেন, কারণ বিনিয়োগ অনেক কম৤ এই ক্ষেত্রে লাভ এবং লোকসানের হিসেবটা করা হবে কেমন করে? 


        বানান সংস্কারের প্রধান বাধা হল প্রচলিত রীতি পদ্ধতির লেখা থেকে তা দেখতে অন্য রকম হয়ে যাবে(অনীহ লোকেরা বলবেন দেখতে খারাপ হয়ে যাবে)৤ পড়ে বুঝতে প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হবে৤ কিছুক্ষেত্রে দুটি শব্দের বানান একই হয়ে যাবে৤ ফলে তাদের অর্থ উদ্ধার করতে সহসা খানিকটা অসুবিধা হবে৤ 




 ৭৩

       হ্যাঁ, তা হবে বটে খানিকটা৤(অনীহরা বলবেন-- অনেকটা, অনেকখানি)৤ কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট (পরিশ্রম) বা বিনিয়োগের তুলনায় লোকসান অতীব সামান্য, আর তার তুলনায় যে-লাভটা হবে সেটা অনেক অনেক বেশি৤ বাঙালিরা ব্যবসায়িক চরিত্রের নয় বলে ভাববাদী সামান্য লোকসানের শোকে মুহ্যমান হবে৤ ভাষার “সারা দেশটা” একবারে দখলভুক্ত যে হচ্ছে, সে কথাটা উপলব্ধি করতে অনুরোধ করি৤ বানান মুখস্থ করতে হবে না-- একথাটার গভীর অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে বয়স্কদের অবশ্য অনেক অনেক সময় লেগে যাবে৤ 


        বাংলায় সবচেয়ে বেশি ভুল হয় ই/ঈ বর্ণ এবং ি/ী চিহ্ন নিয়ে(ি/ী চিহ্ন নিয়েই সর্বাধিক)৤ তাই প্রথম পরিবর্তনটি এখান থেকেই শুরু হবে৤ বাংলায় “ই” হল মৌলিক স্বরধ্বনি৤ কিন্তু বাংলায় ঈ স্বরধ্বনি মৌলিক স্বরধ্বনি নয়৤ আসলে এটি বাংলায় ব্যবহৃত একটি হরফ মাত্র, একটি ছবি মাত্র, কার্যত এটি বাংলায় নেই, যদিও আমরা ধরে নিই যে, ‘ঈ’ হল বাংলার একটি স্বরধ্বনি৤ ঈ কিংবা তার চিহ্ন ‘ী’ আমরা লিখি বটে, তবে সেটা প্রচলিত অভ্যাসবশে৤ প্রয়োজনে নয়৤ আর তাতেই মনে করি বাংলায় ঈ আছে৤ আমরা ‘ক’ কিংবা ‘খ’ ব্যবহার করে একটি শব্দ লিখলে, আমরা ক-স্থানে ‘খ’ বসাতে পারব না৤ কারণ তার উচ্চারণ তাতে আর ঠিক থাকবে না৤ ‘কাল’ এবং ‘খাল’ এক নয়৤ কিন্তু নীতি স্থানে নিতি লিখলে তার উচ্চারণে পার্থক্য করা যাবে না৤ যদিও অর্থ পালটে যাবে৤ কিন্তু নদী লিখতে নদি লিখলে তার উচ্চারণ এবং অর্থ কোনওটাই পালটাবে না(বর্তমান বানান অনুসারে)৤ তাহলে নদি লিখতে দোষ কোথায়? তেমনি-- খুশি, গাড়ি, দেশি, পাখি, বাড়ি, বেশি, শাড়ি, হাতি ইত্যাদি তো চলছেই৤ আগে এসবই ছিল-- খুশী, গাড়ী, দেশী, পাখী, বাড়ী, বেশী, শাড়ী, হাতী ইত্যাদি৤ 

        কিন্তু এরকমভাবে এক-একটা শব্দ ধরে সংস্কার করতে গেলে, তা মুখস্থ করেও মনে রাখা যাবে না, এবং তাতেও শেষ রক্ষা হবে না৤ এখন তো আমরা এই কান্ডই করি৤ মুমূর্ষু-- বানান মুখস্ত করি আর যথাসময়ে তা ভুলও করি! আবার ‘নদি’ লেখা হলে ‘নদিয়া’ লিখব কিনা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়, এবং অনেক সময় বহু ক্ষেত্রে সে সবের সমাধান পাওয়া কঠিন৤ চীন এবং চিন তার উদাহরণ৤ 


         বাংলায় আছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ, তার এক-একটি শব্দ ধরে দু’হাজার বা দশ হাজার নিয়ম তৈরি করায় পরিশ্রম আছে, কিন্তু সুফল নেই একটুও৤ আর সেসব মোটেই সত্যিকারের সংস্কার(overhauling/reformtion) নয়, বরং হচ্ছে বিধি তৈরি (formulation) করা৤ 

        বাংলা বানান সংস্কার করতে হবে গোড়া থেকে, দড়ি ছিঁড়ে গেলে তা গিঁট দিয়ে সাময়িক কাজ চলে, কিন্তু তা আবার ছিঁড়বে শীঘ্রই, তাই সেখানে নতুন দড়ি লাগাতে হবে, জোড়াতাপ্পি দিয়ে বেশি দিন চলবে না৤ বাংলা বানানে আর কত জোড়া তাপ্পি দেওয়া হবে? অর্থাৎ সংস্কার কাজটি করতে হবে মূল এবং মৌলিক বর্ণ ধরে৤ তাই, বাংলায় ‘ই-ঈ’ এই দুটির কেবলমাত্র “ই” বর্ণটি বজায় থাকবে, এবং ‘ঈ’ বর্ণটি বর্জিত হবে, কারণ ‘ঈ’ বাংলার কোনও মৌলিক বর্ণ নয়৤ এতে লোকসান কিছু আছে সে কথা ঠিকই৤ কিন্তু তুলনায় লাভের পাত্রটি পূর্ণ হবে অনেক বেশি৤ আমরা লাভের কারবারেই যাব, অল্প লোকসানের ব্যবসায়ে নয়! অর্থাৎ অতি সামান্য বিনিয়োগ করতে পিছিপা হব না৤ সেসকল ক্ষেত্রে বানান একই হয়ে অর্থ বিভ্রাট হতে পারে তার পরিমাণ, ই-ঈ সহ সকল বাংলা শব্দ মিলে হবে (প্রায়) ০.৬ শতাংশ, আর কেবলমাত্র ই-ঈ এই একটিতেই লাভ হবে ৮.৬৭%শতাংশ৤ অর্থাৎ বাংলার মোট ৮.০৭%শতাংশ (৮.৬৭ - ০.৬=৮.০৭%শতাংশ) বানান সংকট কমে যাবে৤ অবশ্য এই বিশাল লাভটিও বাঙালির হয়তো পছন্দ হবে না৤ অল্প লোকসানের অতি-ভয়টাই তাকে অনেক বেশি ম্রিয়মাণ করে তুলবে! বাঙালির অ-ব্যবসায়িক চরিত্রের এটাই লক্ষণ!  


         অভিজ্ঞ এবং বিজ্ঞরা বলবেন, যা-ই বলুন শেষ অবধি এটা করা যাবে না, লোকে এসব মানবে না৤ তাহলে খুশী, গাড়ী, দেশী, পাখী, বাড়ী, বেশী, শাড়ী, হাতী কেমন করে খুশি, গাড়ি, দেশি, পাখি, বাড়ি, বেশি, শাড়ি, হাতি-- হল? বিজ্ঞরা ভাবছেন খোল নলচে পালটে হুকোর উত্তরাধিকার রক্ষা করার কথা, কিন্তু তা নয়, ঈ/ী বর্জন করে শুধু ই/ি চলুক দশ বছর, আর কোনও সংস্কার নয়৤ তারপরে পরের সংস্কারে হাত দেওয়া হবে৤ সামনে সময় অঢেল ভাবনার কিছু নেই, এক জীবনে না হোক তিন প্রজন্ম ধরে না হয় কাজটা হবে! বাংলায় বানান বিভ্রাট চলছে তো হাজার বছর ধরে, একটু একটু করে তা সংস্কার করতে নাহয় লাগুক আরও বিশ পঁচিশ বছর, বাধা কীসের? তবে শব্দ ধরে ধরে সংস্কার করার ভাবনা ত্যাগ করতে হবে৤ মৌলিক সংস্কারে হাত দিলে বানান সংস্কার হতে খুব বেশি দিন লাগবে না, শব্দ ধরে ধরে সংস্কার করলে আগামী হাজার বছরেও তা হবে না, হতে পারে না৤


        আমরা বাংলাভাষাকে সহজ সরল সুন্দর এবং আরও প্রিয় করতে চাই, কোনও প্রকার জেদ বজায় রাখা উদ্দেশ্য নয়৤ ভাষা হল জীবন-জীবিকার মূল হাতিয়ার, তেমনি ভাষা হল একটি অলিখিত সমাজিক চুক্তিও 




৭৪

        মনস্ক ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ পবিত্র সরকার বলেছেন-- “একটি শব্দ যা উচ্চারণ করি তার বানান যদি ঠিক সেইভাবে লেখা না যায়, তাহলে বানান ভুল হবেই৤” ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে তিনি বলেছেন, one sound, one symbol, ধ্বনি ও বর্ণচিহ্নের সম্পর্কটি হল-- one-one corresondence, তাঁর অভিমত-- “শুদ্ধ উচ্চারণ ও শুদ্ধ বানান, শিক্ষা ও সচেতনতার পরিচয় বহন করে”৤ 


        বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে বাংলা বানানে মিলবে না, কারণ বাংলা বানান তো আসলে সংস্কৃত বানান৤ মুখের বলা অনুযায়ী বাংলায় প্রায়ই বানান লেখা হয় না৤ ফরাসিভাষী(বাংলায় অতীব সাবলীল এবং বাঙালির মতো দক্ষ বাংলা লিখিয়ে) ফাদার দ্যতিয়েন কৌতুক করে যা বলেছেন, তা আর একবার উল্লেখ করি--“বাঙালিরা বুঝলাম বলে এক, আর লেখে আর এক৤” সে কৌতুকের অবসান করতে হলে, বাংলা উচ্চারণ অনুযায়ী বাংলা শব্দের “বাংলা বানান”-ই লিখত হবে, সংস্কৃত বানান লিখলে হবে না৤ যদিও সে সাহস বাঙালির বুকে নেই৤ সব রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার তো৻ আমিও তো সেই স্রোতেই ভেসে চলেছি৤


         সংস্কৃত পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষার শত্রু নন, তাঁরা বাংলাভাষার মান উন্নত এবং সুনির্দিষ্ট ও পরিচ্ছন্ন করতে চেয়েছেন৤ তাতে বাধা নেই, এখন তাই সাধিত শব্দগুলি “বাংলা বানানে” লিখতে হবে (একাধিক শব্দের সমাস হয়ে কিংবা ধাতু ও শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ হয়ে যে-শব্দ তৈরি হয়, তা-ই সাধিত শব্দ... মৌলিক শব্দ ছাড়া অন্য যেকোনো শব্দই সাধিত শ্রণির --অশোক মুখোপাধ্যায়, সংসদ ব্যাকরণ অভিধান)৤ তাই ‘আত্মীয়’ শব্দটির যা বাংলা উচ্চারণ তার বানান করতে হবে তেমনিই, শব্দটির বানান হবে-- আত্তিয়৤  


       বাংলায় ব্যবহৃত সংস্কৃত বা অন্য যেকোনও ভাষা থেকে আগত তথা দেশি-বিদেশি যেকোনও শব্দের ক্ষেত্রই তার বানান হবে বাংলা মান্য উচ্চারণ অনুযায়ী৤ এ রীতি হবে ব্যতিক্রমহীন৤ 



        বাংলাভাষা ও বানান সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত ৬টি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে-- (১)বর্ণমালা সংস্কার, (২)নতুন লিপি নির্মাণ, (৩)বর্ণমালার সজ্জা, (৪)লিখন পদ্ধতির সংস্কার, (৫)লিপির গঠন, (৬)যুক্তবর্ণ সংগঠন৤ 

এজন্য বাংলাভাষা সংস্কারের বিষয়গুলি হল-- (১)বানান, (২)আঙ্গিক, (৩)অবয়ব৤


বানানের মধ্যে থাকছে-- (১.১)বর্ণমালার সংস্কার-- গ্রহণ, বর্জন (১.২)লিপি-- নির্মাণ৤ 


আঙ্গিকের মধ্যে থাকছে-- (২.১)বর্ণমালার সজ্জা, (২.২)লিখন পদ্ধতি৤


অবয়বের মধ্যে থাকছে-- (৩.১)লিপির গঠন, (৩.২)যুক্তবর্ণ সংগঠন৤


অর্থাৎ বাংলাভাষা সংস্কারের কাজ বহুস্তরীয়, এবং বহুমাত্রিক ও বিচিত্র৤


        বাংলা ছাপাখানার সূচনা ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে(১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধের ২১ বছর পরে), তখন যাঁদের হাতের লেখা অনুসরণ করে বিভিন্ন সময়ে বাংলা ছাপাখানার টাইপ তৈরি করা হয় তাঁরা হলেন-- (১)খুশমৎ মুনশি, (২)কালীকুমার রায়, (৩)হরমোহন দত্ত৤ এঁদের হাতের লেখাকে অনুসরণ করে বাংলা টাইপ তৈরি হবার ফলে বাংলা ছাপা এবং বাংলা হাতের লেখা বেশ কাছাকাছি আকৃতির৤ 

        বাংলা ছাপাখানার সূচনায় যাঁদের ভূমিকা স্মরণীয় তাঁরা হলেন-- (১)চার্লস উইলকিনস্‌ ১৭৪৯/৫০--১৮৩৬[জীবনকাল ৮৭ বছর], (২)ন্যাথানিয়েল ব্যাসি হ্যালহেড ১৭৫১--১৮৩০[জীবনকাল ৭৯ বছর], (৩) পঞ্চানন কর্মকার, তাঁর জামাতা (৪)মনোহর মিস্ত্রি, এবং জামাতার পুত্র (৫)কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি৤ 

        বাংলা আধুনিক যান্ত্রিক লাইনো মেশিনের ছাপাখানায় যাঁদের কৃৎ-কৌশল এবং সহায়তা অবশ্য স্বীকার্য তাঁরা হলেন-- (১)সুরেশচন্দ্র মজুমদার, (২)যতীন্দ্রকুমার সেন, (৩)এস কে ভট্টাচার্য(মূল অক্ষরগুলির আকৃতি অঙ্কন করিয়াছেন শ্রী যতীন্দ্রকুমার সেনের সহায়তায় শ্রীযুত এস কে ভট্টাচার্য),[পরশুরামের মজার বইয়ে কৌতুকচিত্র এঁকে বিখ্যাত হয়ে আছেন এই যতীন্দ্রকুমার সেন] (৪)কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিভাষিক সমিতির সভাপতি রাজশেখর বসু(লেখক পরশুরাম), (৫)পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরমান ব্রাউন, (৬)লাইনোটাইপ কোম্পানির ভারতীয় শাখার ম্যানেজার এ জে মে, (৭)আমেরিকান লাইনোটাইপ কোম্পানির মিঃ গ্রিফিথ, মিঃ গোভিল প্রভৃতি৤ 

        ইউরোপে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে লাইনোটাইপ উদ্ভাবনের ৫০ বছর পরে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাভাষায় লাইনোটাইপ চালু হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়৤




৭৫

        তবে বাংলায় লাইনোটাইপ চালুর পিছনে অন্য এক ঘটনার কথাও জানা যায়৤ র পিছনে যাঁদের নাম খ্যাত হয়ে আছে তাঁরা নমস্য৤ কিন্তু তারও অধিক আরও কিছু নাম শোনা যায় যাঁরা ছিলেন এর প্রকৃত হোতা৤ তাঁদের চিন্তাভাবনা এর পিছনে কাজ করেছে৤ যদিও তাঁরা  খ্যাতির আলোয় আসেননি৤ এব্যাপারে তথ্যের জন্য “বর্ণপরিচয়” পত্রিকাটি দেখা যেতে পারে(বর্ণপরিচয়, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০০৯, পৃঃ ২৩১-৩৬, বাংলা টাইপ ও কেস-- অজরচন্দ্র সরকার)৤ সেখানে একটি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ-- ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করিতে গিয়া আমাকে পুনঃ পুনঃ বলিতে হইয়াছিল যে, বাঙ্গালা বানান ঠিক না হইলে বাঙ্গালা টাইপ ও কেসের সংস্কার হইতেই পারে না৤’ 


        বাংলায় কম্পিউটার কম্পোজিং শুরুর কাজে যাঁদের নাম শোনা যায় তাঁরা হলেন-- (১)মিস ফিয়োনা রস, (২)দুলালচন্দ্র সরকার৤ অবশ্য দুলালচন্দ্রের নাম এব্যাপারে কোথাও তেমন পাওয়া যায় না৤ (ডঃ ফিয়োনা রস একটি বই লিখেছেন--The Printed Bengali Character and its Evolution বইখানিতে বাংলা ছাপার হরফের যে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে তার দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, তিনি নিজে লাইনো টাইপের কাল থেকে বাংলা হরফ নির্মিতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত৤ তারপরে যখন বাংলায় ডিজিটাল টাইপ এলো, স্বাভাবিকভাবে তার ভূমিকা প্রধান হবে একথা অবিসম্বাদিত৤ বইখানির ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন, কোলকাতার সাহিত্য সংসদ, ২০০৯)৤ 

        যাঁরা বাংলা কম্পিউটার সফ্‌টওয়্যার তৈরির পাইয়োনিয়ার তাঁরা হলেন-- (১)ডঃ সমর ভট্টাচার্য(যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়), আশির দশকের শুরুতে৤ তার কিছু আগে পি সি(PC), বা পারসোনাল কম্পিউটার(Personal Computer) প্রথম তৈরি হয়ে বাজারে আসে৤ কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য তার গবেষণা শুরু করেন অধ্যাপক ডঃ তপন ঘোষালের অধীনে৤ সমরবাবু সফল হয়ে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন৤ সেটাই কম্পিউটারে প্রথম বাংলা লেখার ব্যবস্থা৤ অবশ্য অন্য মতও আছে একটি তথ্য জানাচ্ছে যে (২)‘পলাশ বরন পাল’ কম্পিউটারে প্রথম বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন৤ অন্য একটি মত আছে যে বাংলাদেশে  বিজয়খ্যাত (৩)মোস্তাফা জব্বার কম্পিউটারে প্রথম বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন ('বিজয়' নামে তিনি নিয়ে আসেন প্রথম বাংলা ইনপুট সফটওয়্যার। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে এই বিজয়।)৤ 


        বাংলা ছাপাখানার উন্নতি অনেক হয়েছে৤ বিশ্বের অন্যত্র ছাপাখানায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত প্রবেশ করেছে, বাংলাছাপাখানায়ও তা ক্রমে গৃহীত হয়েছে৤ অবশ্য বাংলা ছাপাখানার যত উন্নতিই হোক, ‘বাংলা বানানের সংস্কার’ কিন্তু সে তুলনায় তেমন এগোয়ইনি৤ এগোয়নি তার একটা কারণ বাংলা বানান-সংস্কারের ভার প্রযুক্তিবিদদের হাতে নয়৤ তাই তা তেমন এগোতে পারেনি৤ প্রযুক্তিবিদেরা বাংলা বানান সংস্কার করার চেষ্টাও যে করেননি তা নয়, তবে তাঁরা পূর্ণ সাহসের সঙ্গে এগোতে পারেননি, বা তাঁরা সেই গুরুত্ব পাননি৤ প্রযুক্তিবিদেরা যতখানি বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা নিয়ে বানান সংস্কার করতে পারতেন, বাংলাভাষা চর্চাকারীরা তা করতে পারেননি, ফলে বাংলাভাষা বঞ্চিত হয়েছে৤ অবশ্য বাংলা ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ এবং বাংলাভাষা-চর্চাকারী হিসেবে প্রথমদিকে বিদ্যাসাগরই এ ব্যাপারে সবচেয়ে সফল৤ তাঁর করা বাংলা বর্ণমালার-সংস্কারের সুফল এখনও আমরা ভোগ করছি৤ লাইনো টাইপের কালে অপ্রত্যক্ষভাবে সে কাজ বেশ কিছুটা হয়েছিল, কিন্তু পিটিএস (Photo Type Setting), বা কম্পিউটার কম্পোজিং তথা ডিটিপি(Desk Top Publishing) যখন এলো, তখন তা আবার ফিরে গেছে সেই পুরানো আমলে৤ অতি আধুনিক  যন্ত্র কম্পিউটারকে আমরা শিখিয়েছি অতি পুরানো  কায়দায় লিখতে! কম্পিউটার সবই পারে, তাই তা আমাদের পুরানো অভ্যাসকে জিইয়ে রাখতে কাজে লাগিয়েছি, আর যন্ত্র কম্পিউটারও অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে সে-কাজ করে চলেছে৤  




 ৭৬

        একটা সহজ কথা আমাদের স্বীকার করে নেওয়া দরকার, তা হল এই যে, আমাদের মাপজোক, হিসেবনিকেশ, সময় পরিমাপ ইত্যাদিতে কোনও ভালো মান বা স্ট্যান্ডার্ড নেই 
(ন-এর মুণ্ডুটুকু নিয়ে ড-এর সঙ্গে জুড়ে দিব্যি যুক্তবর্ণ হয়েছে!  




         বারো ইঞ্চিতে এক ফুট, এটা একটা সুনির্দিষ্ট মাপ৤ কিন্তু এক হাত ঠিক কতটা দীর্ঘ? বেশি লম্বা লোকের হাত বেশ বড়, সে ক্ষেত্রে হাত এক রকম, খর্ব লোকের ক্ষত্রে তা অন্য রকম, অনেকটা ছোটো৤ একশ’ হাত পরিমাণ দৈর্ঘ্য দু-জনার ক্ষেত্রে দুরকম হবে, বিরাট পার্থক্য হবে৤ 

        আবার এক প্রহর সময় ব্যাপারটা খানিকটা অনুমানভিত্তিক সময়, প্রায় তিন ঘণ্টা-- আট প্রহরে একদিন, ২৪ ঘণ্টায় একদিন(ইংরেজি সময় পরিমাপের ঘড়ি না হলে ঠিক কতক্ষণ তা বোঝা কঠিন)৤ 


        ইংরেজি মতে নতুন দিনের সূচনা হয় রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাংলা মতে দিনের শুরু হয় শেষ রাতে, যখন আকাশের তারা সব ডুবে যায়৤ ফলে যাঁর দৃষ্টি ক্ষীণ তাঁর দিন অনেক আগে শুরু হয়, আর প্রখর দৃষ্টিশক্তির অধিকারীদের দিন শুরু হয় অনেক দেরিতে! 


         বানানের ক্ষেত্রেও আমাদের এই একই ধরনের হাতড়ানো ব্যাপারটা বেশ রয়েছে, তাই একই শব্দের বানান একাধিক হয়, নানা রকম হয়৤ 


     এই অতি আধুনিক মহাকাশ ও কম্পিউটারের যুগে 








সেকেন্ডের গতির যুগে আমাদের হতে হবে খুব সুনির্দিষ্ট, স্পষ্ট, নির্দ্বিধ-- দ্বিধাহীন৤ 


        কম্পিউটার মাত্র এক সেকেন্ডে কোটি কোটি অঙ্ক কষে৤ কম্পিউটারের কাছে একটা হরফের যা গুরুত্ব, একটা অতি ছোটো বিন্দুরও ঠিক সেই একই সমান গুরুত্ব, অর্থাৎ সব সময়েই সে খুব সু-নির্দিষ্ট, স্পষ্ট, এবং নির্দ্বিধ৤ আমাদেরও সেই গুণটি অর্জন করতে হবে, তবেই বাংলা বানান সব সময়ে নির্দ্বিধ হবে৤ শৈথিল্য বা লাগামছাড়া ভাব আমরা না ছাড়লে আমাদের বানান কি করে সুনিয়ন্ত্রিত হবে? তেমন আশা কি করা যায়? আমরা কাছা-ছাড়া হলে আমাদের কাছা কি আপনিই এঁটে বসবে! তাই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে স্পষ্ট সুনির্দিষ্ট হবার-- বাস্তব জীবনে, ভাষা ও বানানে৤ অজরচন্দ্র সরকার যে বলেছেন, ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করিতে গিয়া আমাকে পুনঃ পুনঃ বলিতে হইয়াছিল যে, বাঙ্গালা বানান ঠিক না হইলে বাঙ্গালা টাইপ ও কেসের সংস্কার হইতেই পারে না’  বাংলায় বানান সংশোধনের সফ্‌টওয়্যার তৈরি না হওয়ার কারণও সেই একই, অর্থাৎ আমাদের বানান সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট নয়৤


        কেউ যদি Nathaniel Brassey Halhed কৃত A GRAMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE গ্রন্থটি দেখেন, তবে তিনি প্রাচীন বাংলা ভাষা, তার বানান পদ্ধতি, তার উচ্চারণ, প্রথম তৈরি বাংলা টাইপ, তথা বাংলা ফন্ট ইত্যাদি দেখতে পাবেন, এবং দেখে চমৎকৃত হবেন৤ আজকের বাংলার সঙ্গে তার অনেক তফাত৤ সেসব পরিবর্তন হয়েছে আপন গতিবেগেই, কাউকে চেষ্টা করে তা করতে হয়নি৤ এটাই হচ্ছে ভাষার স্বাভাবিক নিয়ম৤ যদি বর্তমান বাংলাভাষার সংস্কার না করে আমরা চুপ করে বসেও থাকি, তবুও তার স্বাভাবিক পরিবর্তন হবেই, সেটা কেউ ঠেকাতে পারবে না৤ কারণ ভাষা তো জীবিত মানব সমাজের ব্যাপার, প্রাচীন মৃত সমাজের ভাষার কোনও পরিবর্তন হয়না৤ সুতরাং জীবিত মানব সমাজের ভাষার পরিবর্তন হবেই, কিন্তু সে পরিবর্তন হবে সম্পূর্ণ অ-নিয়ন্ত্রিত পথে৤ ফলে তা আমাদের কিছু সুবিধাও করতে পারে, বা কিছু অসুবিধাও করতে পারে৤ 


         নৌকায় স্রোতের বেগে যদি আমরা ভাসতে থাকি, তবে স্রোত আমাদের যেদিকে নিয়ে যাবে, আমরা সেদিকেই যাব, তা আমাদের কাজে লাগুক বা না লাগুক, কিংবা স্রোত আমাদের অঘাটেই নিয়ে যাক, স্রোত তো আমাদের মনোবাসনা বুঝতে পারবে না! হাতে বৈঠা থাকলে স্রোতকে আমরা আমাদের ইচ্ছা বোঝাতে পারি, স্রোতের গতিবেগকে আমরা আমাদের প্রয়োজন ও ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি৤ যদি ভাষার পরিবর্তনের ধারাকে আমরা আমাদের বাস্তব এবং সঠিক প্রয়োজন, সুবিধা ও ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, বা করি, তবে তা হবে আমাদের পক্ষে মঙ্গলজনক, তা হলে আমরা বাংলাভাষাকে প্রয়োজন ও সুবিধামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারব৤ ভাষা ব্যবহারের পক্ষে যা আমাদের এক খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দেবে৤ আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে বা ঈপ্সিত বিন্দুতে পৌঁছাতে পারব৤ সেজন্যই ভাষা সংস্কার করা দরকার৤ নয়তো লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো, বাংলাভাষা যে-পথে যেমনভাবে আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের সেই খামখেয়ালির হাটের মাঝে ভারসাম্যহীনতার উপরেই নির্ভর করে চলতে হবে৤ ভাষার উপরে আমাদের প্রকৃত কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকবে না৤  




 ৭৭

        হ্যালহেড সাহেবের বইখানিতে দেখা যাবে বাংলা স্বরবর্ণ ছিল ১৬টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি, এই মোট ৫০টি বর্ণ৤ এ কথাই বিদ্যাসাগর মহাশয় বলেছেন তাঁর বর্ণপরিচয় বইখানিতে৤ স্বরবর্ণে ছিল দীর্ঘ-ৠ, দীর্ঘ-ৡ , ছিল অং(লেখা হয়েছে অ৹), অঃ৤ এই অং আর অঃ বর্ণদুটিকে বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যঞ্জনবর্ণে স্থানান্তরিত করেন ং ঃ হিসেবে৤ এছাড়া, দীর্ঘ-ৠ, দীর্ঘ-ৡ বর্ণমালা থেকে বর্জন করেন৤ চন্দ্রবিন্দু(ঁ ) বর্ণমালায় ছিল না(এখনও যেমন কোথাও নেই হস্‌ চিহ্নের স্বীকৃতি), হ্যালহেড সাহেবের বইখানি দেখলেই সেটা স্পষ্ট হবে৤ বিদ্যাসাগর মহাশয় ব্যঞ্জনবর্ণে চন্দ্রবিন্দুর( ঁ ) স্থান করে দেন৤ র-বর্ণটি বর্তমান চেহারায় ছিল না, পেটকাটা ব-বর্ণটিকে ধরা হত ‘র’ বলে, আসলে তখন র ছিল= র/ব/ৰ এই তিনটি চেহারায়৤ অসমিয়াতে ৰ=র ধরা হয়৤ 


         “ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, ড়, ঢ়, য় হয়; ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে৤ কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পর ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত, উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে”(--বিদ্যাসাগর)৤ [হ্যালহেড সাহেবের বইখানিতে যে বর্ণমালা দেখানো হয়েছে(পৃঃ-৪), সেখানে ড় ঢ় য় দেখানো হয়নি ঠিকই কিন্তু  ভিতরে শব্দের উদাহরণে ড় য় দেখানো হয়েছে৤ এমনকি প্রচ্ছদের শব্দে য় দেখানো হয়ছে]৤ অধুনা বাংলায় যেমন ইংরেজি Z[জেড্‌] ধ্বনিকে বোঝাবার জন্য চেষ্টা হচ্ছে বর্গীয় জ-এর তলায় বিন্দু(.) বসিয়ে জ় লেখার৤ আনন্দবাজার পত্রিকা-গোষ্ঠী ব্যাপারটিকে পৃষ্ঠপোষণ করছে৤ 

        ‘ক্ষ’ হল ক+ষ, সুতরাং এটি যুক্তবর্ণ, তাই অ-সংযুক্ত বর্ণমালা থেকে বিদ্যাসাগর এটি বাদ দেন৤ হ্যালহেডের বইখানিতে উ এবং ঙ দুটোই ছিল একইরকম দেখতে, কেবল উ-এর মাথার পুঁটুলিটার উপর-দিকটা ছিল একটুখানি ফাঁকা 
উ=
,  







 ঙ=

  






  
 
       আর মূর্ধন্য-ণ এবং ল ছিল একই রকম দেখতে, কেবল 

মূর্ধন্য-ণ= বর্ণে মাত্রা ছিল না, 



ল-এর   মাত্রা ছিল৤ 



          পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৮১-তে যখন প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেন, তখন সে পুস্তকে অন্তঃস্থ-ব বর্জন করা হয়৤ বর্গীয়-ব, এবং অন্তঃস্থ-ব এই দুটি বর্ণের গঠনে বা উচ্চারণে বাংলায় কোনও তফাত নেই৤ অসমিয়া অন্তঃস্থ-ব হল ‘ৱ’৤ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বর্ণপরিচয়’ প্রকাশের (এপ্রিল ১৮৫৫) ১২৭ বছর পরে(১৯৮১) বাংলা বর্ণমালা আবার সংস্কার করা হল৤ অর্থাৎ পরিবর্তন হচ্ছে, কেবল তা সময় মতো, প্রয়োজন মতো হয়ে উঠছে না, ফলে আমরা এর সুফল পুরোটা তো পাচ্ছিই না, বরং বেশিটাই হারিয়ে যাচ্ছে-- অপচিত হচ্ছে৤ 




 ৭৮

        বিদ্যাসাগর মহাশয় এত সব সংস্কার বা পরিবর্তন করেছেন(১৮৫৫) বলে বাংলাভাষা এতখানি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে৤ বিদ্যাসাগরের জন্ম ২৬-০৯-১৮২০, অর্থাৎ হ্যালহেড Nathaniel Brassey Halhed-এর  A Grammar of the Bengal language,[১৭৭৮] প্রকাশের ৪২ বছর পরে৤ সে আমল গেছে প্রায় দু-শতক আগে, এবার আবার তাই বাংলাভাষা সংস্কার হওয়া দরকার৤ অন্তত প্রত্যেক ১০০ বছর পরে পরে ভাষা সংস্কার হওয়া দরকার৤ ফরাসি ভাষার মতো একটি স্থায়ী সংস্থা থাকলেই ভালো হয়৤ যাঁরা বাংলাভাষা সংস্কারের পক্ষে নন, তাঁরা পরোক্ষে (জেনে বা না-জেনে) বাংলাভাষার গতি-প্রগতিকে রোধ করছেন৤ দু-শো বছর আগে টোলে পড়া সংস্কৃত পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের করা ভাষা ও বানান সংস্কার সেই ইঙ্গিতই দেয়, যাঁরা বাংলাভাষা সংস্কারের পক্ষে নন, তাঁরা সে ইঙ্গিত যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, দেশ ও জাতির পক্ষে তা ততোই মঙ্গল৤ এখন এযুগের আধুনিক এবং বিজ্ঞান শিক্ষিত পণ্ডিতেরা টুলো পণ্ডিতের কাছে হার মানছেন! 

        হ্যালহেড সাহেবের বইখানির পৃষ্ঠা ১৮ থেকে ২২ অবধি দেখলে বাংলা যুক্তবর্ণ কেমন করে গঠন করা হয়েছে তা অনেকটা স্পষ্ট হবে৤ বিদেশি বলেই এ-দেশীয়  কোনও প্রাক-সংস্কার (Prejudice) না-থাকায়, অতখানি যুক্তিভিত্তিক যুক্তবর্ণ গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল, অথবা এই পদ্ধতিকে তিনি সহজ বলে মনে করেছিলেন৤ কিন্তু মজার কথা এই যে, তিনি বাংলা যুক্তবর্ণগুলিকে ঠিক আমাদের মতো বেশ করে পেঁচিয়ে দলা পাকিয়ে মণ্ড বানাতে পারেননি বলে আমরাই বরং তাঁকে খুব করুণা করেছিলাম যে-- সাহেব তো, তাই বাংলায় আমাদের মতো দক্ষ নয়! বিদ্যাসাগরের কাছে জন মারডক(John Murdoch) ২২-০২-১৮৬৫ তারিখে (বর্ণপরিচয় পুস্তকখানি প্রকাশের ১০ বছর পরে) বাংলা বানান সংস্কারের যে-প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাতে তিনি বাংলা যুক্তবর্ণ লেখার এক যুক্তিভিত্তিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা ছিল খানিকটা হ্যালহেডের রূপায়িত যুক্তবর্ণের মতোই(Letter to Babu Iswarchandra Vidyasagar on Bengali Typography--John Murdoch)৤ মনে রাখতে হবে যে, হ্যালহেড সাহেবের বইখানি ইংরেজিতে লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ৤ বিদেশি বলেই সেখানকার চিন্তাভাবনা খুবই গুরুত্ব পাবার যোগ্য৤ আর একটি কথা হল এই যে, এখানে সংস্কৃত লেখা হয়েছে বাংলা হরফেই, কারণ বাংলা হরফই হল বঙ্গভাষী এই অঞ্চলের সংস্কৃত লেখার লিপি৤ এখানে দ্ম, হ্ন, হ্ম, গ্ধ এভাবে অর্থাৎ দুটি বর্ণ পাশাপাশি বসিয়ে লেখা হয়েছে৤ হায়, এখনও কি আমরা যুক্তবর্ণ তৈরি করার জন্য দুটি হরফ শুধু পাশাপাশি বসিয়ে তার ধ্বনি-সংযুক্তি অনুভব করতে পারব না? এখনও নয়! 

        সরল এবং যুক্তিঋদ্ধ এই পদ্ধতি দেখে আমাদের মনে উলটে বরং করুণাই হয় এই ভেবে যে, যুক্তবর্ণগুলিকে তাঁরা আমাদের মতো যথেষ্ট দলা পাকাতে পারেননি! এটা তাঁদের অর্থাৎ ওই বিদেশিদের অজ্ঞতা, অযোগ্যতা, ব্যর্থতা! 

        আমরা কি এই আধুনিক যুগে পৌঁছেও চিন্তাভাবনায় পিছিয়ে পড়ছি? যদি সত্যিই তা হয়, তবে তা দূর করার সর্বতো উদ্যোগ নেওয়া দরকার৤ এবং তা এখুনিই৤ 

        ইংরেজিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত বর্ণ হল ‘ই’(E) আর বাংলায় সর্বাধিক ব্যবহৃত বর্ণ হল-- ‘র’৤ বাংলা বর্ণতুলনাংক(letter frequency) বিচার করে এটা বোঝা গেছে৤ বাংলা লিখতে গিয়ে, বা ছাপার সময়ে কোন্‌ হরফ কতবার ব্যবহৃত হয় সে ব্যাপার লক্ষ করতে গিয়ে বাংলা বর্ণতুলনাংক(letter frequency) বিচার করতে হয়েছে৤ এর ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে৤ দেখা গেছে যে বাংলায় বানান ভুলের সাধারণ আশঙ্কা হল ৩১.৭৬%শতাংশ৤ আর সর্বমোট ভুলের বিচারে তা হল ৫৪.১২%শতাংশ৤ যদিও এত ভুল সাধারণত হয় না, কিন্তু সম্ভাবনার সূত্র অনুসারে এই পরিমাণ ভুল হতে পারে, অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রতি তিনটে হরফের একটা ভুল হতে পারে৤ এব্যাপারে বিস্তারিত বলতে গেলে বড় এক প্রবন্ধ হয়ে যাবে, তাই সংক্ষেপে দু-একটি কথা বলা যাক৤ 


        দেখা গেছে বাংলায় যুক্তবর্ণের ব্যবহার ৮.২২৪% শতাংশ (অর্থাৎ খুবই বেশি)৤ স্বরচিহ্নের ব্যবহার ৩২.২৫%শতাংশ, অথচ সরাসরি স্বরবর্ণের ব্যবহার ৫.২১%শতাংশ (স্বরচিহ্ন খুব বেশি বার ব্যবহৃত হবার কারণে তা সরাসরি স্বরবর্ণ হিসেবে না-লিখে সহজে ব্যবহারযোগ্য চিহ্ন তৈরি করে নেওয়া হয়েছে প্রাচীন দিনেই)৤ ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার ৫৪.৩১%শতাংশ৤ ই,ঈ বর্ণ এবং এদুটির স্বরচিহ্ন মিলে মোট ব্যবহার হল ৮.৬৭% শতাংশ, অর্থাৎ এদুটি মিলে লেখার প্রধান অংশ জুড়ে থাকে৤ ঠিক একারণেই প্রস্তাবিত বানান সংস্কার শুর করা হয়েছে-- ঈ, ি ী দিয়ে৤ 




 ৭৯


        বাংলা বানানে এত যে বিশাল ভুলের আশঙ্কা তার প্রায় সবটুকুই দূর হবে বানান সংস্কার করার পরে৤ তখন বানান আর ভুল হবে না৤ বরং বলা ভালো যে, ভুল আর প্রায় করাই যাবে না৤ ভুল করতে হলে বরং চেষ্টা করতে হবে, কৌশল করতে হবে৤ 

        আমরা বলি ফলা এবং যুক্তাক্ষর৤


   


ইত্যাদি হল ফলার উদাহরণ৤ আর  

  
  


ইত্যাদি হল যুক্তাক্ষর বা যুক্তবর্ণ৤ 




         দুটো ক্ষেত্রেই ব্যঞ্জনবর্ণে এবং ব্যঞ্জনবর্ণে মিলন ঘটছে, তাহলে একটিকে কেন বলা হচ্ছে ফলা, আর অন্যটিকে বলা হচ্ছে যুক্তবর্ণ? তার কারণ হল, যে-সকল ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্তবর্ণের “পরবর্ণ” হিসেবে বারবার ব্যবহৃত হয়(রেফ  র্‍়  অবশ্য পূর্ববর্ণ), সেগুলিকে হাতে করে দ্রুত লেখার সুবিধার জন্য বিশেষ এক-একটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ রূপ দেওয়া হয়েছে৤ এজন্যই এগুলির পৃথক নাম দেওয়া হয়েছে ফলা (ফলক কথাটি থেকে এসে থাকতে পারে)৤ অন্য ব্যঞ্জনগুলি এত বেশিবার ব্যবহৃত হয়না৤ তাই সেগুলির কোনও পৃথক নাম দেওয়া হয়নি৤ অবশ্য তুলনামূলকভাবে ণ-ফলার ব্যবহার কম৤ সুতরাং ফলা এবং যুক্তাক্ষর তথা যুক্তবর্ণ মূলত একই ব্যাপার, কেবল এদের ব্যবহারিক নাম আলাদা৤ 

        টাইপরাইটার কিবোর্ড দেখলে মনে হবে তার হরফগুলো কেমন এলোমেলো ভাবে বসানো৤ কিন্তু আসলে তা নয়৤ বরং তা খুবই বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাজানো৤ আমরা যেভাবে ক খ গ ঘ ঙ করে বা ABCD করে হরফ সাজানোর সঙ্গে পরিচিত, এখানে তেমন করে সাজানো নয় বলে আমাদের মনে হয়, এসব কেমন এলোমেলো৤ কম্পিউটার কিবোর্ডেও ঠিক একইভাবে হরফ সাজানো৤ ছাপাখানায়ও ঠিক একই ব্যাপার৤ কেন এমন করে হরফগুলো বিন্যস্ত? তার কারণ হল, যে-বইগুলি আমরা যেমন, বেশি বেশি ব্যবহার করি সেই অভিধান, কবিতা, বিজ্ঞান বা রবীন্দ্ররচনাবলী হাতের খুব কাছেই রাখি, অন্যগুলো থাকে একটু দূরে, তেমনি যে-যে হরফ আমরা বেশিবার ব্যবহার করি সেই হরফগুলো কিবোর্ডে রাখা হয় সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থানে৤ কিবোর্ডের হরফ বিন্যাস সেজন্যই এলোমেলো মনে হয়৤ আসলে তা মোটেই এলোমেলো নয়৤ স্বর এবং ব্যঞ্জনবর্ণ সমূহের আমরা যে নতুন সজ্জা করেছি তাও তো এমনি ধরনের সুনির্দিষ্ট বিশেষ কারণ থেকেই-- বর্ণমালার নতুন সজ্জা আমরা করেছি উচ্চারণ-স্থানের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে পর পর সাজিয়ে৤ কারণ সেটাই যুক্তিসংগত, অন্যথায় বর্ণমালা সাজাতে হত বর্ণ ব্যবহারের ক্রম অনুসারে, অর্থৎ যে বর্ণের ব্যবহার বেশি তা থাকবে প্রথম দিকে-- অর্থাৎ 
                 ইত্যাদি৤ 



৮০

          কিন্তু তাতে উচ্চারণ-স্থান উল্লম্ফন হবে, এবং বর্ণের প্রকৃতি বিবেচিত হবে না, বা স্বর-ব্যঞ্জনের পৃথক বিন্যাস বা সত্ত্বা থাকবে না, কিংবা বর্ণের অবরোহী ক্রমের ফলে শেষ দিকে অবস্থিত বর্ণগুলি কিছুটা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে৤ বাংলা বর্ণমালার প্রচলিত সজ্জা অনিশ্চিত, কোন্‌ বর্ণের পর কোন্‌ বর্ণ থাকবে, এবং কেন থাকবে তা নিশ্চিত নয়৤ ভাষাবিজ্ঞানীরা তাঁদের রচিত গ্রন্থে বাংলা বর্ণমালার আলোচনাকালে বাংলা বর্ণসমূহ যেভাবে সাজিয়েছেন তাতে একজনের সঙ্গে আর একজনের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি দেখা যায়৤ বাংলা বর্ণমালার সেই সজ্জা দেখে বলা যাবে না যে, কখগঘঙ এর পরে চছজঝঞ, কিংবা টঠডঢণ এর পরে তথদধন হবে৤

        ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু বর্ণ সাজিয়েছেন মোটামুটি--
পফবভম  তথদধ        চছজঝ      টঠডঢ  ড়ঢ়  কখগঘঙ  ইত্যাদি করে৤

        ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ কৃষ্ণপদ গোস্বামী বর্ণ সাজিয়েছেন মোটামুটি--
পবম  ফভ  তথদধ          টঠডঢ  ড়ঢ়    চছজঝ    কখগঘ    ইত্যাদি করে৤

        ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বর্ণ সাজিয়েছেন মোটামুটি--
  কখগঘ    টঠডঢ      চছজঝ            তথদধ  পফবভ    ইত্যাদি করে৤

        হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ‘বাংলার পুরানো অক্ষর’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘হরিবর্মদেবের রাজত্বে যশোহরে লেখা বৌদ্ধ পুথির ব্যঞ্জনবর্ণ’ বিষয়ক যে চিত্র দেখিয়েছেন, তাতে “চিত্রে শেষ ছত্রে ব্যঞ্জনবর্ণগুলি সব দেওয়া আছে৤ কিন্তু জানি না, কোন্‌ কারণে আগে প-বর্গ, তাহার পর ত-বর্গ দেওয়া আছে৤” (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ, পৃঃ-৬৯৪-৯৫)৤ কোন্ যুক্তির ভিত্তিতে ব্যঞ্জনবর্ণের ক্রম অন্য রকম করা হল তা বোঝা না গেলেও তার পিছনে কোনও কারণ অবশ্যই ছিল৤  

        এসব অনিশ্চয়তা ছেড়ে উচ্চারণ-স্থানের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে বাংলা বর্ণমালা সজানো হবে৤

        ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা যখন প্রথম তৈরি হয়, তারপরে নানা সময়ে নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে এটি পাঠানো হয়৤ তাঁদের কেউ কেউ এর জবাব দিয়েছেন, কেউ বা দেননি৤ এটি নিয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা স্থানে একাধিক সেমিনার হয়েছে৤ কখনও সেখানে আগ্রহ দেখা গেছে, কখনওবা বিরূপতা দেখা গেছে৤ যাঁরা বিষয়টি বোঝেন তাঁরা প্রবল আগ্রহ দেখিয়েছেন, যাঁদের এ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই তাঁরা হয়তোবা বিরক্তই হয়েছেন৤ আবার ডঃ পবিত্র সরকার খুবই আগ্রহ দেখিয়ে প্রশংসা করেছেন৤ এটি দৈনিক সংবাদপত্র ‘আজকাল’-এ প্রকাশিত হবার পরে(২১-০২-১৯৮৪), দুজন গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্রে এটি রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন(ডঃ সমর ভট্টাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, এবং গীতিকা চক্রবর্তী, যাদবপুর রিজিওনাল প্রিন্টিং টেকনোলজির গ্রন্থাগারিক)৤ যাদবপুরের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র পলিটেকনিক কলেজে এটি নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করেন যাদবপুর রিজিওনাল প্রিন্টিং টেকনোলজির অধ্যাপক দীপঙ্কর সেন৤ সেখানে একজন হিন্দিভাষী পড়ুয়া নিজের ভাষায় এরকম হরফ গড়ার প্রবল আগ্রহ বোধ করেছেন৤ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক মিলে “বর্ণচর্চা” নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন৤ সেখানে ছিলেন ডঃ পবিত্র সরকার, অশোক মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর সেন, প্রসূন দত্ত, সমর ভট্টাচার্য, ডঃ তপন ঘোষাল এবং আরও অনেকে৤ ঘটনাচক্রে রবাহূত হয়ে আমারও সেখানে অন্তর্ভুক্তি ঘটল৤ 




 ৮১

 
        ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’ গড়ার সরকারি উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৮৫-তে একটি বাংলাভাষা-সেমিনারের মাধ্যমে৤ সেখানে আহূত হয়ে ‘বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা’ একটি পেপার হিসেবে পড়া হয়৤ পরে ১৯৮৬-তে “পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি” গঠিত হবার সময়ে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ “প্রসঙ্গ : বাংলাভাষা”-তে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৤ একটি সাময়িক পত্রে(সারস্বত) ১৯৭৫-এ এটি প্রথম প্রকাশিত হয়, এবং ‘আজকাল’ দৈনিকে দু-বার প্রকাশিত হয়েছে৤ যেসকল প্রাজ্ঞ সুধীজনকে এটি দেখানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন--  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন ও পবিত্র সরকার ও অন্যান্য সুধীজন৤ সুকুমার সেন মহাশয় এর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন যে, আপনার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত৤ পবিত্র সরকারে কথা আগেই বলেছি৤ সাহিত্য অকাদেমির আঞ্চলিক সচিব এটির সমাদর করেছেন৤ বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এটি পেয়ে ভূয়সী প্রসংশা করে বলেছেন এটি বাংলাদেশের আমাদেরই করা উচিত ছিল৤ 

        সেপ্টেম্বর ২০০৫ -এ ‘বাংলা এখন’ এবং ‘তারা নিউজ’ চ্যানেলে এটি সংবাদ হিসেবে দেখানো হয়েছে৤ তবু একথা ঠিক যে এটি এখনও জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি৤ সবাই যে প্রশংসা করেছেন তাও নয়৤ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে একজন অধ্যাপক ব্যঙ্গ করেছেন, বাংলা আকাদেমির সেমিনারেও এটি তেমন সমাদর পায়নি, অবশ্য তার কারণও আছে৤ এর কারিগরি দিকটি সম্পর্কে চেতনা সবার থাকা সম্ভব নয়, নেইও, তার ফল তো পেতেই হবে!  

        পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, বাপু হে এত সব আত্মপ্রচারের  প্রয়োজন কী? প্রয়োজন এই যে, বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা তৈরি হওয়া দরকার, সবাইকে সে কথা জানানো, কিন্তু কে সেটা তৈরি করলেন সেটা প্রধান ব্যাপার নয়৤ অন্য কোনও ব্যক্তি যদি এটি আবার নতুন করে তৈরি করেন আরও সুন্দর করে তৈরি করেন তবে তাকে স্বাগত৤ একাধিক ব্যক্তি তৈরি করলে তা আরও বেশি স্বাগত৤ মোট কথা বাংলা ইঞ্জিনিয়ারিং বর্ণমালা তৈরি হওয়া চাই-ই৤ বাংলা ভাষাকে সামনের সারিতে ধরে রাখতে হলে এটা অবশ্যই চাই৤ শুধু সামনে নয়, বাংলা ভাষাকে রাখতে হবে সবার চেয়ে এগিয়ে-- বাংলাভাষা থাকবে সবার উপরে, সবার শীর্ষে৤

সবার শীর্ষে রাখতে তাই
বাংলা ভাষা শ্রেষ্ঠ চাই৥

--  ০০  --





৮২


         বাংলার বাঘ স৙঄র আশুতৗশ মুখৗপাধ্ধায় মহাশয় জা বল৙ছ৙ন এখান৙ তার উল্ল৙খ করী-- 
        “জদী এামন ভাব৙ বংগভাশার শম্পদ ব্‍রীদ্ধী করা জায় জ৙, শম্পু৒ন রুপ৙ মানুশ হইত৙ হইল৙ অপরাপর ভাশার ন৙঄য় বংগভাশাও শীখীত৙ হয়, এবং না শীখীল৙ অন৙ক অবশ্শ গ৙঄৺তব্ব বীশয় চীরকাল৙র মতৗ অগ্গ৙঄৺ত থাকীয়া জায় ও ওন্ন শত ভাশা শীখ্খা করীয়াও পুরা মানুশ হওয়া না জায়, তব৙ই বংগভাশা জগত৙ চীরস্থায়ীনী হইব৙, বাংলার ভাশা জগত৙র ওন্নান্ন প্‍রধানতম ভাশার স্‍র৙নীত৙ শমুন্নীত হইব৙৤ ওন্নথা বংগ৙র তথা বংগভাশার গৗউরব বড়ীল কই? বংগশাহীত্ত বলীল৙ই জাহাত৙ এাকটা বীরাট শাহীত্ত বুঝায়, বীশ্শ৙র ওন্নতম প্‍রধান শাহীত্ত বুঝায়, এামনভাব৙ বংগশাহীত্ত৙র গঠন করীত৙ হইব৙৤ কীছুই অশম্ভব নহ৙৤ চ৙শ্টা ও এাকাগ্‍রতা থাকীল৙ এই শংশার৙ শপ্নক৙ও বাস্তব৙ পরীনত করা জায়৤ কাল অনন্ত এবং প্‍রীথীবী বীশাল, শুতরাং ব৙঄স্ততার কারন নাই৤ ধীর৙ ধীর৙ পদবীখ্খ৙প পু৒বক আমার জননী বংগভাশাক৙ অনন্তকালরুপী অখ্খয় বট৙র ছায়াশীতল তলদ৙শ৙ লইয়া জাইয়া বংগ৙র পুজনীয় ভাশাক৙ জগত৙র পুজনীয় করীত৙ হইব৙৤” (রবীন্দ্‍রনাথ৙র নৗব৙ল পুরশ্কার পাবার আগ৙ এটী লীখীত) 

--------


        রবীন্দ্‍রনাথ শারা জীবন ক৙বল বাংলা ভাশায় তাঁর শাহীত্ত রচনা কৗর৙ গ৙ছ৙ন তা-ই নয়, বাংলাভাশা নীয়৙ও ওতী গভীরভাব৙ অন৙ক চ৒চা কর৙ছ৙ন৤ তীনী বল৙ন-- “বাংলাভাশা ভংগীওয়ালা ভাশা৤ ভাব প্‍রকাশ৙র এরকম শাহীত্তীক রীতী ওন্ন কৗনৗ ভাশায় আমার জানা ন৙ই৤ --(বাংলাভাশা পরীচয়)৤

---------


        জাঁরা বাংলাভাশায় গভীরভাব৙ মধুপ৙র মতৗ নীমজ্জীত ছীল৙ন, এাখনও আছ৙ন, এবং ভবীশ্শত৙ও থাকব৙ন, তাঁদ৙র শকল৙র প্‍রতী আমার বীনম্‍র অভীবাদন জনীয়৙ শ৙শ করছী৤

----



        এই শংস্কার প্‍রস্তাব শম্প৒ক৙ আপনার অবশ্শই কীছু বলার আছ৙৤ কৗনও প্‍রকার দীধা না র৙খ৙ তা বলল৙ বা জানাল৙, শকল প্‍রকার পরাম৒শ, নী৒দ৙শ, আদ৙শ এবং মতামত পাঠাল৙ বাধীত হবৗ৤ তীখ্ন তীব্‍র বীরুপ মৎ জানাত৙ও কৗন বাধা ন৙ই, তা এই প্‍রকল্পক৙ তথা বাংলাভাশা শংস্কার প্‍রক্‍রীয়াক৙ কা৒জত শম্‍রীদ্ধই করব৙৤ জানাল৙ আমার প্‍রতী বীরুপতা প্‍রকাশ পাব৙ ঠীকই, কীন্তু বাংলা ভাশার প্‍রতী আপনার গভীর ভালৗবাশা এবং নীশ্ঠা প্‍রকাশ পাব৙৤ 
বীনয়াবনত,
মনৗজকুমার দ. গীরীশ
এপ্‍রীল-২০১৪

‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ বাংলা ইউনিকোড ফন্ট ফ্রি ডাউনলোড করার লিংক:


৥আলোচনা সমাপ্ত৥



৮৩




মনোজকুমার দ. গিরিশ(৭০)

৯১/২, ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসু রোড,
মণীশ পার্ক,
কোলকাতা--৭০০ ০৩৯
ভারত

সম্পাদিত, এপ্রিল- ২০১৪ 



---------------------------------------- ০০ ----------------------------------------


এখানে বাংলা বানান সংস্কারের চূড়ান্ত অবস্থা দেখানো হয়েছে৤ এই পর্যায়ে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগবে৤ আপাতত ই-ঈ ি--ী সংস্কার দিয়ে প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হবে, আর পরবর্তী ধাপের সংস্কার শুরু হবে প্রথম পর্যায়ের সংস্কারটি সম্পূর্ণ আত্মস্থ হলে তারপরে৤






নিবেদন:
     এই নিবন্ধের মধ্যে নানা স্থানে নিজের এক্তিয়ারের বাইরে আধিকারিকদের(Authority) মতো কথা বলা হয়েছে৤ সেটা পাঠকেরা নিজ গুণে ক্ষমা করে নেবেন৤ অক্ষমেরা নিজের অধিকার প্রায়ই লঙ্ঘন করে থাকে৤ এখানেও সেটাই ঘটেছে৤ বরং পাঠকেরা নানা পরামর্শ দিয়ে নিবন্ধকারকে সহায়তা করলে লেখক চির কৃতজ্ঞ থাকবে৤

মনোজকুমার দ. গিরিশ               
২৬-০৪-২০১৪ 






৮৪

আমার তৈরি যে ব্লগগুলিতে বাংলাভাষা চর্চা নিয়ে কিছু নিবন্ধ দেখা যাবে:--

১৤বাংলামগ্ন              : http://banglamagna.blogspot.in/
২৤বাংলা-বিশ্ব            : http://bangla-biswa.blogspot.in/
৩৤বাংলা ইন্টারন্যাশনাল :  http://banglainternational.blogspot.in/



‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্ট এবং কিবোর্ড দিয়ে সব কিছু লেখা হয়েছে৤
পরবর্তী সময়ে টাইপিং-এর গতি বাড়াবার জন্য ফন্ট এবং কিবোর্ড
যথাযথ সংস্কার ও সম্পাদনা করতে হবে৤  
--  ০০  --



সংবাদ: [ আফ্রিকার সিয়েরালিওন ] ২০০২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে দেশটি।(দৈনিক ইত্তেফাক৤ ঢাকা, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)


সরকারি উদ্যোগে বাংলা ফন্ট:
ইন্টারনেটে আর কম্পিউটারে যখন বাংলা অনেকটা জায়গা দখল করে নিতে সমর্থ হয়েছে, তখন দেরিতে হলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়ে
ছে একটি ইউনিকোড ফন্ট তৈরির।...গত বছরের শেষের দিকে সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করে।...সরকারি উদ্যোগে তৈরি বাংলা ইউনিকোড এই ফন্টের নাম দেওয়া হয়েছে 'আমার বর্ণমালা'। (দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, শনিবার, ২৯ মার্চ ২০১৪)




http://pipilika.com/site_ajax_calls/show_details/1086215/bn/new_window
ভাষা ও ফন্টবিষয়ক গবেষণা, সংরক্ষণ ও বিকাশের দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলা একাডেমী। আজ বুধবার ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মঙ্গলবার বাংলা একাডেমী আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। নতুন উদ্ভাবিত ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা অভিধানের বিষয়ে জামিল চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে যুক্তাক্ষরগুলো আমূল পাল্টে যাবে। নব উদ্ভাবিত অভিধানে প্রতিটি যুক্তাক্ষর আমরা স্পষ্ট দেখতে পাব। বর্তমানে অনেক যুক্তাক্ষর রয়েছে, যা কেবল অক্ষরটিই দেখে থাকি।  তিনি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে বলেন, যেকোনো যুক্তাক্ষরের প্রথম অক্ষরটি ছোট এবং অপরটি তুলনামূলকভাবে একটু বড় হবে। ফলে শব্দ বিন্যাসে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।




মানবকণ্ঠ(ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) 

আমার বর্ণমালা : বাংলা একাডেমীর নেতৃত্বে দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে ইউনিকোড সুবিধাসংবলিত নতুন বাংলা ফন্ট আমার বর্ণমালাতৈরি ও বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন। অমর একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর পর ল্যাপটপে ক্লিক করে আমার বর্ণমালাউদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।





Bangladeshi Tech. News
Thursday, December 2, 2010
বাংলার ঢেঁকি, আফ্রিকায় তুলেছে উৎপাদনের ছন্দ
কাজী জহিরুল ইসলাম

২০০৮-এর জুন মাস। মান শহরের অতি সন্নিকটে অবস্থিত দুটি গ্রাম পেতি জিবপ্লু এবং কাসাপ্লুতে শোনা যায় কু-উ-উ ঢেক, কু-উ-উ ঢেক, শব্দের সঙ্গীত। মানের মেয়েরা এখন ঢেঁকিতে কাসাবা কিংবা ধান ভানছে। কী অবাক হচ্ছেন? ...
সেদিন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটছিলাম সায়েদাবীচের সৈকতে। হঠাৎ এক ষোল বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ কোত্থেকে ছুটে এসে কর্নেল খালেকের দিকে আঙুল তুলে কথ্য বাংলায় বলে, তুই সেব্রোকো থাকস না? কর্নেল খালেক ঘটনার আকস্মিকতায় লাফ দিয়ে দুই ফুট উঁচুতে উঠে যেন সৈকতের নরম বালুর ওপর আছড়ে পড়েন। ছেলেটির নাম মুসা। দরিদ্র কিশোর। পরনে ছেঁড়া জিন্স, স্লিভলেস ময়লা গেঞ্জি। পোক্ত গড়ন। অন্ধকার মুখে ফর্সা একগুচ্ছ দাঁতের উজ্জ্বল হাসি। এরপর সে আমাদের সঙ্গে সৈকতে হেঁটে বেড়ালো অনেকক্ষণ। অনর্গল কথা বলে চলল বাংলা ভাষায়। মুসা বলে, আমি বাংলাদেশে যেতে চাই, আমাকে নিবি? আমি বললাম, নেব, যদি বাংলায় একটা গান শোনাতে পারিস। আমাদের যুগপৎ অবাক করে দিয়ে ও গান ধরল, বুকটা ফাইট্টা যায়, আমার বুকটা ফাইট্টা যায়/ বন্ধু যখন বৌ লৈয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া/ রঙ্গ কৈরা হাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়। শুধু যে গাইলো তা-ই নয়, মমতাজের মতো শরীর দুলিয়ে তালি দিয়ে দিয়ে নাচলো পর্যন্ত।
এমন ঘটনা এখন সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সুদানের আনাচে-কানাচে দেখা যায়। পেতি জিবপ্লু বা কাসাপ্লুতে বাংলার ঢেঁকি এরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা৤




=============== 





নিবন্ধটি তিনবার কম্পোজ করে নেটে আপলোড করা হয়েছে৤ 
২০০৫-এ, ২০১২-তে এবং ২০১৪-তে
শেষেরটি রাখা হল,
 সর্বান্তিক ‘অহনলিপ-বাংলা১৪’ ইউনিকোড ফন্টে লেখা৤





সর্বান্তিক পরিমার্জন ১৪/১০/২০১৮


---------------------------------------

Madhhab


----------------------------------------

নতুন করে বাংলা ইউনিকোড ফন্টে নিবন্ধটি কম্পোজ করার পরে, দ্বিধা এড়াবার জন্য পুরানো পোস্টগুলি মুছে দেওয়া হয়েছে৤ তাই সেখানে করা -- Madhab Ch. Basak -এর মন্তব্যও মুছে গেছে৤ তাই সেটি উদ্ধার করে এখানে তুলে দেওয়া হল৤

ব্লগে পিডিএফ ফাইল আপলোড করা যায় না৤ তাই আশা করি এবার ইউনিকোড ফন্টে লেখা পুরোটা একবারেই ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে৤ শ্রীবসাকের আগ্রহ ও পরামর্শের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ৤

-- ম. দ. গ.





লেবেলসমূহ: